এক তরফা ডিক্রির আদ্যোপান্ত

দেওয়ানি আইন

জমি-জমা বা অধিকার আদায়ের বিষয় সংক্রান্ত কিংবা অন্য যে কোনও সিভিল বা দেওয়ানি অধিকার আদায়ের জন্য যদি কেউ আপনার বিরুদ্ধে কোন মোকদ্দমা দায়ের করে অর্থাৎ, সোজা কথায় আপনাকে বিবাদী করে যদি কেউ কোনও দেওয়ানি আদালতে কোন মোকদ্দমা দায়ের করেন, সেই ক্ষেত্রে আপনার প্রতি সমন পাঠানো হবে। লিখিত বক্তব্যের জন্য আপনার কাছে আর্জির কপি পাঠানো হবে এবং নির্দিষ্ট তারিখে আপনাকে আদালতে উপস্থিত হয়ে আপনার লিখিত জবাব দাখিলের জন্য বলা হবে। কিন্তু আপনি যদি সমন পাওয়ার পরেও আদালতে উপস্থিত না হয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রে সেটি কি আপনার হিতে বিপরীত হবে কিনা, আজকে আমরা সেই বিষয়ে আলোচনা করব। 

দেওয়ানি কার্যবিধির ৯ আদেশের ৬ বিধি অনুসারে, যদি বিবাদীর প্রতি যথাযথ ভাবে সমন জারি করা হয়, কিন্তু তারপরও বিবাদী আদালতে উপস্থিত না হয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রে আদালত একতরফা বিচার করে বাদীর পক্ষে একদম ডিক্রি প্রদান করতে পারবেন। সমন পেয়েও আদালতে উপস্থিত না হলে আদালতের বিচার স্থগিত থাকলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হবে না। কেননা আমরা জানি, Justice delayed is justice denied. 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এক তরফা ডিক্রি কি? 

এক তরফা ডিক্রি হচ্ছে বিবাদীর অনুপস্থিতিতে যে ডিক্রি প্রদান করা হয়। অর্থাৎ যদি কোনও বাদী এক বা একাধিক বিবাদীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি আদালতে কোনও মোকদ্দমা দায়ের করে, কিন্তু ঐ বিবাদীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, বিবাদী আদালতে উপস্থিত হয়ে সেই অভিযোগের বিরুদ্ধে নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন না করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আরও সহজ ভাষায় বললে, সমন পেয়েও আদালতে উপস্থিত না হয়, সেই ক্ষেত্রে আদালত বাদীর পক্ষে একতরফা ডিক্রি প্রদান করবেন। 

সাধারণত বিবাদীর প্রতি সমন জারি করার পর বিবাদী যখন আদালতে উপস্থিত হয় এবং উভয়পক্ষ যুক্তিতর্ক ও প্রমাণের মাধ্যমে মামলার বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়, সেই ক্ষেত্রে যে রায় প্রদান করা হয়, তাকে দুই তরফা সূত্রে ডিক্রি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু যখন বিবাদী উপস্থিত থাকে না, সেই ক্ষেত্রে শুধু বাদীর উপস্থিতি ও বিবাদী অনুপস্থিতিতে মামলার বিচার করা হয়, যাকে আমরা এক তরফা বিচার বা এর রায়কে এক নামে এক তরফা ডিক্রি বলে জানি। 

উট পাখিকে যখন কেউ তাড়া করে, তখন উট পাখি গিয়ে তার মাথা বালির মধ্যে ঢুকিয়ে পেলে, যার ফলে উট পাখি আর কাউকে দেখতে পায় না, তখন তার ধারনা/বিশ্বাস জন্মায় যে, সে যেহেতু কাউকে দেখছে না, তাকেও কেউ দেখছে না। আদতে উট পাখিকে বাকিরা সবাই দেখতে পারছি। উট পাখি যে সময়ে নিজে নিরাপদ স্থানে পালাতে পারতো বা আত্মরক্ষা করতে পারতো, সেই সময়টি সে নষ্ট করেছে আত্মগোপনে থেকে। তাই, মামলা মোকদ্দমার ক্ষেত্রেও আত্মগোপনে বা পালিয়ে বেড়ালে আপনি নিজের দোষেই নিজে মামলায় পরাজিত হবেন। 

এখন কথা হচ্ছে, যদি অনিচ্ছাকৃত ভাবে কোন যুক্তিযুক্ত কারণে একজন বিবাদী ধরুন আপনি যদি আপনার বিরুদ্ধে দায়ের কৃত কোন দেওয়ানি মোকদ্দমায় সমন পাওয়ার পরও আদালতে হাজির না হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে মোকদ্দমা আপনার বিরুদ্ধে একতরফা নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আপনি বিবাদী চাইলে সেই ডিক্রি রদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আপনি দুইভাবে একতরফা ডিক্রি রদের আবেদন করতে পারেন। যদিও দুইটি উপায়ই প্রায় একই ধরনের। বুঝার সুবিধার্থে আমরা সাধারণ ভাষায় এক তরফা ডিক্রি রদের নিয়মটি নিম্নে উল্লেখ করছিঃ

দেওয়ানি কার্যবিধির ৯ আদেশের ১৩ এবং ১৩ক বিধি অনুসারে সাধারণত এক তরফা ডিক্রি রদ করা যায়। এই ডিক্রি রদ করার জন্য আপনাকে বিবাদী হিসেবে যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে সেটি হচ্ছে, আপনি বিবাদী হিসেবে সমন পাওয়ার অধিকারী। সমন না পেলে আপনি কিভাবে জানবেন যে, আপনার বিরুদ্ধে কেউ মামলা/মোকদ্দমা দায়ের করেছে, বা কিসের মামলা দায়ের করেছে। এমনটা কিন্তু আমাদের দেশে হয়ে থাকে যে, চিঠি পাঠালে সেটি সময়মত পৌঁছায় না, আবার যখন পৌঁছায় তখন সেটির হয়ত তামাদিই থাকে না। 

১৩ বিধি অনুসারে এক তরফা ডিক্রি রদের আবেদন করার ক্ষেত্রে বিবাদীকে প্রমাণ করতে হবে যে তার বরাবরে সমন জারি করা হয়নি বা উপযুক্ত কোন কারণে বিবাদী শুনানির দিন আদালতে হাজির হতে পারেন নি। এক্ষেত্রে এক তরফা ডিক্রি রদের আবেদন করতে হবে ৩০ দিনের মধ্যে।

কিন্তু, ১৩ক বিধি অনুসারে এক তরফা ডিক্রি রদের আবেদনের ক্ষেত্রে আদালত বিলম্ব অবসান ও বিচার ত্বরান্বিত করানোর জন্য বিবাদী বরাবর সমন জারি করা হয়নি বা উপযুক্ত কোন কারণে বিবাদী শুনানির দিন আদালতে হাজির হতে পারেন নি বলে আদালতকে সন্তুষ্ট করার জন্য পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপনের নির্দেশ না দিয়ে সরাসরি এক তরফা ডিক্রি রদের আদেশ দিতে পারে। তবে একই সাথে আদালত বিবাদীকে অনধিক ৩০০০/- তিন হাজার টাকা খরচ প্রদানের আদেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রেও এক তরফা ডিক্রি সরাসরি রদের আবেদন করতে হবে ৩০ দিনের মধ্যে।

এক তরফা ডিক্রির বিরুদ্ধে ডিক্রি রদ বা সরাসরি রদের আবেদন করলেই যে আদালত তা গ্রাহ্য করবে তা কিন্তু নয়। আদালত গ্রাহ্য করতে পারেন আবার অগ্রাহ্যও করতে পারেন। 

এক তরফা ডিক্রির বিরুদ্ধে ডিক্রি রদ বা সরাসরি রদের আবেদন গ্রাহ্য/মঞ্জুর করলে বাদী উক্ত মঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করতে পারবেন। 

অপরদিকে,  এক তরফা ডিক্রির বিরুদ্ধে ডিক্রি রদ বা সরাসরি রদের আবেদন অগ্রাহ্য/নামঞ্জুর  করলে বিবাদী উক্ত নামঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করতে পারবেন।  

আশা করি, আজকের পর থেকে আর কখনো মামলা মোকদ্দমা হলে আর পালিয়ে বেড়াবেন না। যে বা যারা এখন মামলা মোকদ্দমা হলেই পালিয়ে বেড়ানোকে উত্তম উপায় মনে করে, তাদেরকে দয়া করে এই আর্টিকেলটির লিংক ইনবক্স করে দিন, ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.