দেওয়ানি মামলা

দেওয়ানি আদালত সমূহের আর্থিক এখতিয়ার

দেওয়ানি আইন বিবিধ আইন

আপনার একটি জমি সংক্রান্ত মামলা বা যেকোনো দেওয়ানি সংক্রান্ত মামলা যখন আপনি আদালতে দায়ের করতে যাবেন, তখন কোন আদালতে দায়ের করবেন, সেই বিষয়টি যদিও একান্ত আইনজীবীর দায়িত্ব, তারপরও একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনার মামলার বিষয়বস্তুর পাশাপাশি আদালতের প্রাথমিক শ্রেণী বিন্যাস সম্বন্ধে ধারনা রাখা উচিত। আজকে আমরা দেওয়ানী আদালতের শ্রেণী বিন্যাস নিয়ে একটি প্রাথমিক আলোচনা করবো। শুরুতেই জেনে রাখা ভালো যে, মামলার ধরনের উপর ভিত্তি করে আদালতকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে; ফৌজদারি মামলা, দেওয়ানি মামলা। দেওয়ানি মামলাকে আমরা মামলা বলে সম্বোধন করলেও একে আইনের ভাষায় মোকদ্দমা বলা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে ফৌজদারি মামলাকে Criminal Case আর দেওয়ানি মোকদ্দমাকে Civil Suit হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। কিন্তু, বলতে বলতে সবার মুখে এখন দেওয়ানি মোকদ্দমাকেও দেওয়ানি মামলা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। তাই, আমাদের ওয়েবসাইটে কোথাও দেওয়ানি মামলা উল্লেখ করা হলে সেটি দেওয়ানি মোকদ্দমা হিসেবে পাঠক দয়া করে গ্রহণ করে নিবেন। এবার আসুন, দেওয়ানি আদালতের স্তরসমূহ নিয়ে আলোচনা করা যাক।

পটভূমিতেই বলে রাখা ভালো যে, আদালতের শ্রেণী বিন্যাস বা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করার পিছনের কারণ হচ্ছে, সকল মামলা বা মোকদ্দমার মাত্রা কিন্তু সমান না। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে যেমন অপরাধের মাত্রা একেক অপরাধের ক্ষেত্রে একেক রকম, তেমনি দেওয়ানি মোকদ্দমার ক্ষেত্রেও একেক মোকদ্দমার বিষয়বস্তু একেক রকম। খুন আর চুরির অপরাধ যেমন সমান নয়, তেমনি ১ লক্ষ টাকার জমির মোকদ্দমা আর ১ কোটি টাকার জমির মোকদ্দমা সমান নয়। এই যে মোকদ্দমার বিষয়বস্তুর মূল্যমান বা আর্থিক দিক বিবেচনা করে আদালতের যে এখতিয়ার নির্ধারণ করা হয়, তাকে আদালতের আর্থিক এখতিয়ার বলা হয়ে থাকে। আর্থিক এখতিয়ার ছাড়াও আদালতের আঞ্চলিক এখতিয়ার রয়েছে। মোকদ্দমার বিষয়বস্তু যেখানে, মোকদ্দমা আপনাকে সেখানে করতে হবে। কিন্তু আদালতের যে স্তর বিন্যাস, সেটি সাধারণত আদালতের আর্থিক এখতিয়ারের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। সাধারণত আমাদের প্রত্যেক জেলা ভিত্তিক যে আদালত রয়েছে, তার মধ্যে দেওয়ানি মোকদ্দমার জন্য সর্বোচ্চ আদালত হচ্ছে জেলা জজ আদালত। তারপর হচ্ছে, অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, এরপর যুগ্ম জেলা জজ আদালত। সবশেষে রয়েছে, সিনিয়র সহকারী জজ আদালত এবং সহকারী জজ আদালত। যদিও সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপীল বিভাগেও দেওয়ানি মোকদ্দমা দায়ের করা যাবে। কিন্তু, যেকোনো মোকদ্দমা দায়েরের ক্ষেত্রে যে সাধারণ বিষয়টি মনে রাখতে হবে সেটি হচ্ছে, যেকোনো মোকদ্দমা দায়েরের ক্ষেত্রে এখতিয়ারাধীন সর্বনিম্ন আদালতে দায়ের করতে হবে। যেমন ধরুন, সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ার হচ্ছে ১৫,০০,০০০/- (পনের লক্ষ টাকা পর্যন্ত)। অর্থাৎ, আপনার মোকদ্দমার বিষয়বস্তুর মূল্যমান যদি পনের লক্ষ টাকার সমান বা তার কম হয়, তাহলে সেই মামলা আপনি সহকারী জজ আদালতে করতে হবে। আবার, সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ার হচ্ছে ১৫,০০,০০০/- টাকার বেশী কিন্তু ২৫,০০,০০০/- (পঁচিশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত)। অর্থাৎ, আপনার মোকদ্দমার বিষয়বস্তুর মূল্যমান যদি পনের লক্ষ টাকার বেশী হয় কিন্তু পঁচিশ লক্ষ টাকা সমান বা তার কম হয়, তাহলে সেই মামলা আপনাকে সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে করতে হবে। এখন আপনি ১০,০০,০০০/- (দশ লক্ষ টাকা) মূল্যমানের কোন মোকদ্দমা চাইলেই সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে দায়ের করতে পারবেন না। যদিও সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ার ২৫,০০,০০০/- টাকা পর্যন্ত, কিন্তু যেহেতু সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ার ১৫,০০,০০০/- টাকা পর্যন্ত আছে, সেক্ষেত্রে আপনাকে সর্বনিম্ন আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে। সহকারী জজ আদালত, সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে উপর রয়েছেন যুগ্ম জেলা জজ আদালত। ২৫,০০,০০০/- টাকার উপরে যেকোনো মূল্যমানের মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে। সরাসরি কোন আইনে কোন মোকদ্দমা দায়েরের জন্য জেলা জজকে এখতিয়ার না দেওয়া হলে, সাধারণত আপনি জেলা জজ আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবেন না।
কিছু কিছু মোকদ্দমা দায়েরের এখতিয়ার সরাসরি জেলা জজ আদালতকে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সরাসরি জেলা জজ আদালতে দায়ের করা যাবে, নাহলে জেলা জজ সাধারণত শুধুমাত্র আপীল শুনানি করে থাকেন। আর, অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে সরাসরি কোন মোকদ্দমা দায়ের করা যায় না। জেলা জজ আদালতে সাধারণত যেসব মোকদ্দমা দায়ের করা হয়, সেসব মোকদ্দমা থেকে জেলা জজ কিছু মোকদ্দমা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে হস্তান্তর করে থাকেন। নিচে ছকের মাধ্যমে দেওয়ানি আদালতের আর্থিক এখতিয়ার স্পষ্ট করানো হলো।

আদালত

এখতিয়ার

জেলা জজ আদালত

কোন আইনে সরাসরি জেলা জজকে আদি এখতিয়ার দিয়ে থাকলে কেবল সেসব মোকদ্দমার শুনানি জেলা জজ আদালত করে থাকেন, নাহলে জেলা জজের কাছে শুধু আপীল শুনানিই হয়ে থাকে।

অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত

জেলা জজ আদালত যেসব মোকদ্দমা পাঠান, সেসব মোকদ্দমাই অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত শুনানি করে থাকেন।

যুগ্ম জেলা জজ আদালত ২৫,০০,০০০/- টাকার উপরের যেকোনো মূল্য
সিনিয়র সহকারী জজ আদালত ১৫,০০,০০০/- টাকার বেশী কিন্তু ২৫,০০,০০০/- (পঁচিশ লক্ষ) টাকা পর্যন্ত
সহকারী জজ আদালত ১৫,০০,০০০/- (পনের লক্ষ) টাকা পর্যন্ত

 

আমরা জানি, কোন মোকদ্দমায় আদালতের রায়ে কোন পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি আপীল, রিভিউ, রিভিশন করতে পারেন। রিভিউ একই বা একই শ্রেণীর আদালতে দায়ের করতে হয়। আপীল, রিভিশন করতে হয় উচ্চতর আদালতে। নিম্নে দেওয়ানি আদালতের আপীল এখতিয়ার নিয়ে আলোচনা করা হল। সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দেওয়া ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করতে হবে জেলা জজের নিকট। যুগ্ম জেলা জজ আদালতের দেওয়া ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করতে হবে জেলা জজের নিকট; তবে মোকদ্দমার মূল্যমান যদি ৫,০০,০০,০০০/- (পাঁচ কোটি) টাকার অধিক হয় তাহলে আপীল করতে হবে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে। অর্থাৎ, মোকদ্দমার মূল্যমান যদি ৫,০০,০০,০০০/- (পাঁচ কোটি) টাকার সমান বা কম হয় তাহলে আপীল করতে হবে জেলা জজ আদালতে। তবে, জেলা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করতে হবে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে।

আবার, হাইকোর্ট বিভাগের কোন রায়ে কোন পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আপীল দায়ের করা যায়। এই হচ্ছে, দেওয়ানি আদালতের আর্থিক এখতিয়ার এবং স্তর বিন্যাস; আশা করি, আপনার দেওয়ানি মোকদ্দমা কোথায় দায়ের করতে হবে এবং আপীল কোথায় করতে হবে, সেই বিষয়ে একটি প্রাথমিক ধারনা পেয়েছেন।
ধন্যবাদ।  

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.