নাসিরের সঙ্গে সালেহার সম্পর্ক ছিল একসময়ের ভালোবাসার চিত্র, ফ্রেমে বেঁধে রাখার মতো। দুই পরিবারের সম্মতি নিয়ে তাদের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে নানা কারণে তাদের সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। মসজিদের পাশের বাড়িতে একদম শান্তিপূর্ণ এক পরিবেশে সালেহা আর নাসির একে অপরের সহযাত্রী ছিলেন, কিন্তু তাদের সম্পর্কের মধ্যে যে ক্রমশ দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছিল তা বাহির থেকে বুঝতে পারা যায়নি। কিন্তু তারা দুইজন ঠিকই টের পেয়েছিল তাদের মধ্যকার বাস্তবিক তিক্ত অভিজ্ঞতা। তাই, দুইজনই খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে তাদের বিবাহিত জীবনের ইতি টানা উচিত।
একদিন নাসির তালাকের ঘোষণা দিল। সে একটি হলফনামা তৈরি করে, যা নিশ্চিতভাবেই আইনগতভাবে তার উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করে। কিন্তু সালেহার মনে এ বিষয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। সে জানতো যে, শুধু হলফনামা দিয়েই কাজ হবে না; তালাক কার্যকর করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নোটিশ পাঠানোও জরুরি।
এমন অবস্থায় সালেহা গ্রামপ্রধান বা চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিল, কিন্তু সে দেখলো, চেয়ারম্যানের কাছে কোন নোটিশ আসেনি যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কোনো পদক্ষেপও নিতে পারছেন না। এদিকে নাসিরের মুখে বারবার শুনতে হয় যে, তালাক কার্যকর হয়ে গেছে, কিন্তু সালেহা আইনি ত্রুটির কারণে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল।
একদিন সালেহা কিছুটা হাল ছেড়ে দিয়েও কৌতূহলবশত গ্রামের পরিচিত উকিলবাবুর কাছে এসে হাজির হলো। উকিলবাবুকে তাদের মধ্যকার বিষয়টি নিয়ে সবকিছু খুলে বললেন। সব শুনে উকিলবাবু বললেন, “দেখো সালেহা, তোমার যে উদ্বেগ তা অমূলক নয়। তোমার স্বামীর হলফনামা অনুযায়ী তালাকের ঘোষণা প্রমাণিত। তবে, তুমি যে বলছো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ দেওয়া হয়নি, সেটাও সত্যি। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে শুধু নোটিশ না দেওয়ার কারণে তালাকের কার্যকারিতা প্রভাবিত হবে না।”
উকিলবাবু উদাহরণ হিসেবে, সীরাজুল ইসলাম বনাম হেলেনা বেগম (৪৮ ডিএলআর ৪৮) কেসটির কথা উল্লেখ করলেন। এই কেসে আদালত বলেছে যে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ না দেওয়ার কারণে তালাকের প্রমাণ প্রভাবিত হবে না। আইনের নির্ধারিত ধারা অনুযায়ী, তালাক কার্যকর করতে হলে চেয়াম্যানের কাছে নোটিশ দেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু তালাকের বৈধতা হলফনামা দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।
উকিলবাবু বললেন, “তোমার ক্ষেত্রে যদিও চেয়াম্যানকে নোটিশ দেওয়া হয়নি, তবে তোমার স্বামীর দ্বারা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী তালাক কার্যকর হয়েছে। তোমার উদ্বেগ যে অমূলক নয়, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আইনের চোখে, হলফনামা যথেষ্ট। কিন্তু, মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ধারা ৭(১) অনুযায়ী, কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তাহলে তালাকের ঘোষণার পর যত দ্রুত সম্ভব চেয়ারম্যানকে একটি লিখিত নোটিশ দিতে হবে এবং স্ত্রীর কাছে এর একটি কপি সরবরাহ করতে হবে। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে, তালাকের প্রমাণ এবং কার্যকারিতা বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ধারা ৭(২) অনুযায়ী, যদি কেউ ৭(১) এর বিধান লঙ্ঘন করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে এক বছরের সাধারণ কারাদণ্ড অথবা দশ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এটি নিশ্চিত করে যে, আইন অনুযায়ী তালাক কার্যকর করতে হলে নির্ধারিত প্রক্রিয়া মেনে চলা উচিত”।
উকিলবাবু এবার কেস এবং আইনের সংমিশ্রণে বলেন যে, “সীরাজুল ইসলাম বনাম হেলেনা বেগম (৪৮ ডিএলআর ৪৮) কেসে আদালত বলেছে যে, চেয়ারম্যানকে তালাকের নোটিশ না দেওয়ার কারণে তালাকের প্রমাণ প্রভাবিত হবে না। যদিও ধারা ৭ অনুযায়ী নোটিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক, কিন্তু হলফনামার মাধ্যমে তালাকের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং, চেয়াম্যানকে নোটিশ না দেওয়া হলেও তালাক কার্যকর থাকবে, যদি না কোনো বিশেষ আইনগত বাধা থাকে।”
তিনি আরও বললেন, “তোমার স্বামীর হলফনামার মাধ্যমে তালাকের প্রমাণ মেলে এবং আইন অনুযায়ী তালাক বৈধ হতে পারে। তবে, যদি নোটিশ না দেওয়ার কারণে আইনি শাস্তির মুখোমুখি হয়, সেটা অন্য বিষয়। তবুও, আইন অনুযায়ী, হলফনামার মাধ্যমে তালাকের বৈধতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই, এখন নোটিশ না দেওয়ার কারনে তুমি চাইলে তোমার স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারো। কিন্তু, এটা জেনে রেখো হলফনামার কারনে তালাকের বৈধতা হয়ত নিশ্চিত হয়ে গেছে”।
উকিলবাবু শেষ করলেন এই বলে যে, তুমি সবচেয়ে উত্তম যেটা করতে পারো সেটা হচ্ছে, উভয় পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে বসতে পারো, প্রয়োজনে চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং গ্রামের কয়েকজন পঞ্চায়েতকে নিয়ে তোমাদের মধ্যে কি নিয়ে সমস্যা, কিভাবে সেগুলো সমাধান করে পুনরায় সংসার করা যায়, সেই দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত। জামাইবাবুকে বুঝানো উচিত যে, তিনি পুরনায় বিয়ে করলে সেখানেও সমস্যা হবে, দুনিয়ার সকল দাম্পত্যেই কলহ রয়েছে। তাই, সালিশি পরিষদে নোটিশ দিলো কি দিলো না, এসব নিয়ে পড়ে না থেকে চেষ্টা করো সংসার টিকিয়ে রাখতে এবং সে অনুযায়ী নিজেরাই উদ্যোগ গ্রহণ করো। আর তাতেও কাজ না হলে আদালতে দাম্পত্য পুনরুদ্ধারের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করতে পারো”।
সালেহার মতো অনেকেই তালাকের আইনি প্রক্রিয়া এবং নোটিশের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিভ্রান্ত হন। মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭ অনুযায়ী, চেয়াম্যানকে নোটিশ প্রদান জরুরি হলেও, সীরাজুল ইসলাম বনাম হেলেনা বেগম কেসটি নিশ্চিত করে যে, হলফনামার মাধ্যমে তালাকের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে, নোটিশ না পাঠানোর কারনে এক বছরের সাধারণ কারাদণ্ড অথবা দশ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )