বিকেলের নরম আলোয় ডুবে আছে গ্রামের মেঠোপথ। নদীর পাড়ে বটগাছের নীচে বসে আছে রাশেদা। মাথায় হাত দিয়ে ভাবছে, কিভাবে এমন হলো তার জীবন? অন্য আট দশটা পরিবারের মতো সেদিনও রাশেদা আর তার স্বামী আমিনুলের সংসারে ঝগড়া হয়েছিল, তবে এটা তো তেমন কোনো নতুন ঘটনা নয়। ছোটখাটো মনোমালিন্য তো সব সংসারেই হয়। কিন্তু সেদিন আমিনুল রাগে এতটাই অগ্নিমূর্তি ধারণ করল যে, এক ঝটকায় বলে উঠল, “এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক!” রাশেদার মনে প্রথমে বিশ্বাসই হলো না, তার প্রাণের স্বামী এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে!
কিছুদিন পর রাশেদা জানতে পারল, আমিনুল এই তালাকের কথা চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত আকারে জানিয়েছে। তালাকের নোটিশ আসার পর রাশেদা আর কিছুই করতে পারেনি। তার মন ভেঙে গিয়ে ছিল, এতো প্রেম, এতো ভালোবাসা, এতো মায়া, মমতা আর এতো সব স্মৃতি আমিনুল শুধু তার রাগের জন্য ভুলে যেতে পারবে? সবকিছু এক লাত্থি মেরে উড়িয়ে দিতে পারবে? শুধু মুখের এক কথায় মনের এতো ক্রিয়া বিক্রিয়া মুহূর্তেই কাজ করা বন্ধ করে দিবে? এক ঘোষণাতেই সংসার ভাঙার এই আয়োজন কেমন করে সম্ভব? এমন হাজার প্রশ্ন ঘুরছে রাশেদার মনে। কখনো মনে হচ্ছে, আমিনুলের রাগ থাকলে আমারও রাগ কম নয়, আবার একটু পরই মনে হচ্ছে দোষ তো আমারও ছিল।
এদিকে পরিবার থেকে শুরু করে গ্রামের সবার কাছে সে সমালোচিত হচ্ছে। কিন্তু তার মনে সম্ভাবনা তৈরি করে একটি প্রশ্ন জেগে উঠলো যে, সালিশি পরিষদ (Arbitration Council) কেন তালাকের পর আবারও তাদের মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে না?
রাশেদা তার পরিবারে এই বিষয়টি জানালে রাশেদার মা তাকে বললেন, “ঘর ভেঙে গেলে শুধু ঘরই ভাঙ্গে না, একটা মানুষের স্বপ্ন, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা সবই ভেঙ্গে যায়। বরং চলো, কোনো উকিলের কাছে যাই।” মায়ের কথা শুনে রাশেদা চলে গেলো তাদের গ্রামের বিখ্যাত উকিলবাবুর কাছে।
উকিলবাবু রাশেদার সব কথা শোনার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “দেখো মা, তালাক দেওয়া এবং তা বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় আইনি কিছু ধাপ আছে। তবে সালিশি পরিষদের ভূমিকা নিয়ে অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে। মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ (Muslim Family Laws Ordinance, 1961)-এ ধারা ৭ অনুযায়ী, তালাকের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যখন কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চায়, তখন তাকে চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু এই নোটিশ দেওয়ার পর সালিশি পরিষদের (Arbitration Council) বিশেষ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়নি। ধারা ৭ এর আওতায় চেয়ারম্যানকে তালাকের নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে একটি সালিশি পরিষদ গঠন করতে হবে, যার কাজ হবে উভয় পক্ষের মধ্যে পুনর্মিলনের চেষ্টা করা। কিন্তু আইন অনুযায়ী এটা বাধ্যতামূলক নয় যে, সালিশি পরিষদ যদি গঠিত না হয় বা পুনর্মিলন করার চেষ্টা না হয়, তাহলে তালাক অকার্যকর হয়ে যাবে।”
উকিলবাবু উদাহরণ দিলেন, আব্দুস সোবহান সরকার বনাম মো. আব্দুল গনি (২৫ ডিএলআর ২২৭) কেসটির। এই কেসে আদালত বলেছিল যে, চেয়ারম্যান যদি সালিশি পরিষদ গঠন করতে ব্যর্থ হয়, তবুও তালাক কার্যকর থাকে। কারণ ধারা ৭ এ পরিষদের কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়টি তালাকের বৈধতাকে প্রভাবিত করে না। সালিশি পরিষদ মূলত পুনর্মিলন ঘটানোর চেষ্টা করবে, তবে যদি সেই চেষ্টা না হয়, আইন অনুযায়ী তালাক এখনও কার্যকর থাকে।
উকিলবাবু আরও বললেন, “তুমি যদি মনে করো যে, সালিশি পরিষদের মাধ্যমে তোমাদের পুনরায় একত্রিত করার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়নি, তবে তা আইনের চোখে বড় কোনো ত্রুটি হিসেবে দেখা হবে না।”
উকিলবাবু আরও বলেন, তবে তুমি যেটা করতে পারো সেটা হচ্ছে, উভয় পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে বসতে পারো, প্রয়োজনে চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং গ্রামের কয়েকজন পঞ্চায়েতকে নিয়ে তোমাদের মধ্যে কি নিয়ে সমস্যা, কিভাবে সেগুলো সমাধান করে পুনরায় সংসার করা যায়, সেই দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত। জামাইবাবুকে বুঝানো উচিত যে, তিনি পুরনায় বিয়ে করলে সেখানে সমস্যা হবে, দুনিয়ার সকল দাম্পত্যেই কলহ রয়েছে। তাই, সালিশি পরিষদের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেরাই উদ্যোগ গ্রহণ করো। আর তাতেও কাজ না হলে আদালতে দাম্পত্য পুনরুদ্ধারের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করতে পারো।
রাশেদার মতো অনেক নারী আছেন যারা তালাকের প্রক্রিয়া এবং সালিশি পরিষদের ভূমিকা নিয়ে বিভ্রান্ত হন। কিন্তু মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭ অনুযায়ী, তালাক কার্যকর করার ক্ষেত্রে সালিশি পরিষদ পুনর্মিলনের চেষ্টা করলেও, যদি সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় বা না হয়, তালাক বৈধই থাকবে। তাই, এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করবো যেন, বিয়ে নামক সবচেয়ে প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি ভেঙ্গে যাওয়ার আগে যেন যথা সম্ভব এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা চালানো হয়। এটি আইনি কাঠামোতেই রাখা উচিত, বাধ্যতামূলক ভাবে। মানুষ মাত্রই ভুল এবং এই ভুল সব মানুষের মধ্যেই আছে। তাই বলে যদি আমরা এই ভুল ক্ষমা করে পুনরায় একসাথে থাকতে না পারি, তাহলে বছর বছরই নতুন বিয়ে করতে হবে আর বছর গড়ালেই তালাক।
আমাদেরকে আইন অনুযায়ী নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত এবং প্রয়োজন হলে উপযুক্ত পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত, যেন আইনের মাধ্যমে সঠিক বিচার পেতে পারি। পাশাপাশি আইনগুলোও সময়ের সাথে সাথে সংস্কার করে সময়োপযোগী করা উচিত যাতে সেগুলো মানবতার কাজে লাগে। ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )