কোর্ট ম্যারেজ

কোর্ট ম্যারেজ কি, কেন, কিভাবে?

পারিবারিক আইন

সাধারণত যেসব বিয়ে আদালতে করা হয়ে থাকে কোন উকিলের মাধ্যমে, সে বিয়ে গুলোকেই আমাদের দেশে ‘কোর্ট ম্যারেজ’ বলা হয়ে থাকে। যদিও আদালতের কাজ নয় বিয়ে পড়ানো, বিয়ে পড়ানোর দায়িত্ব হচ্ছে কাজীর। এই জন্যই সরাসরি বলা যায়, কোর্ট ম্যারেজ বলে কোন বৈধ বিয়ে পড়ানোর বিষয় আমাদের আইনে নেই।
আমাদেরকে বিয়ে করার জন্য অবশ্যই শুধুমাত্র কাজীর কাছে যেতে হবে। কাজীর কাছে বিবাহ রেজিস্ট্রি করা ব্যতীত কোনভাবেই বাংলাদেশের আইন অনুসারে বিবাহ সম্পন্ন হবে না। মুসলিম ধর্ম অনুসারে আপনি শুধুমাত্র হুজুরের কাছে খুতবা পাঠের মাধ্যমে যে বিবাহ করা হয়, সেই বিয়েতেও পরবর্তীতে কাজী এনে কাবিননামা রেজিস্ট্রি করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে।

আগেকার দিনে কাবিননামা রেজিস্ট্রেশনের প্রচলন ছিল না বলে তখন হুজুর ডেকে বিবাহ সম্পন্ন করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে, বিবাহের প্রমাণাদি বলে কিছু থাকতো না। কারণ, মুসলিম আইন অনুসারে দুইজন পুরুষ (একজন পুরুষের বিপরীতে দুইজন নারী) সাক্ষীর উপস্থিতিতে দেনমোহর নির্ধারণের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। কিন্তু ওই দুইজন সাক্ষী মারা গেলে বা খুঁজে পাওয়া না গেলে বা অস্বীকার করলে ওই বিবাহ যে সম্পন্ন হয়েছিল দুইজন নারী পুরুষের মাঝে, সেটির কোন প্রমাণ থাকছে না।
তাছাড়া একই ব্যক্তি একাধিক জায়গায় বিবাহ করে থাকলে এবং সেই ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম নিলে তাদের পিতা মাতার পরিচয় প্রদান করার জন্য যে ধরনের জটিলতা তৈরি হয়, সাক্ষ্য প্রমাণ তথা কাবিননামা ব্যতীত সেই জটিলতা নিরসনের কোন সুযোগ নেই।

আবার, আজকাল আমরা অনেক সময় দেখে থাকি ভ্রমণ করতে গেলে বা যেকোনো আবাসিক হোটেল গুলোতে নারী পুরুষ স্বামী স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে থাকলে গেলেও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। কাবিননামা ব্যতীত অন্য কোন ভাবেই নিজেদেরকে স্বামী স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।
হুজুর ডেকে বিবাহ করার যে বিষয়টি, সেটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ হলেও রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে আপনাকে অবশ্যই কাবিননামা রেজিস্ট্রি করতে হবে। কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন করা ব্যতীত আপনি কোনভাবেই রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে নিজেকে বিবাহিত হিসেবে দাবি করতে পারবেন না।

কিন্তু আমাদের দেশে কোর্ট ম্যারেজ নামে যে বিবাহটি প্রচলিত আছে, সেটি আদতে কোন বিবাহ নয়। কেননা কোর্ট ম্যারেজ এর মাধ্যমে আপনি শুধুমাত্র এফিডেভিট বা হলফনামার মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে থাকেন যে আপনি অমুকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, এর বাহিরে আর কিছুই নয়।
বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, আইনজীবীর চেম্বারে হুজুর ডেকে এনে ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে সম্পন্ন করিয়ে থাকে, তারপর এফিডেভিটের মাধ্যমে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিবাহের ঘোষণা দিয়ে থাকেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বিবাহ হিসেবে গণ্য হলেও সেটি রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে বিবাহ হিসেবে গণ্য হবে না। কেননা কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোনো মতেই সেটি বিবাহ হিসেবে গণ্য হবে না। এখন কথা হচ্ছে কেন কোর্ট ম্যারেজ করা হয়ে থাকে?

 

সাধারণত বয়সের সমস্যার কারণে আমাদের দেশে কোর্ট ম্যারেজ করানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিয়ে করার জন্য আপনি ছেলে হলে আপনার ২১ বছর বয়স্ক হতে হবে আর আপনি মেয়ে হলে আপনাকে ১৮ বছর বয়স্ক হতে হবে। অর্থাৎ, একজন ছেলে ২১+ এবং একজন মেয়ে ১৮+ হলেই বাংলাদেশের আইন অনুসারে বিবাহ করতে পারবে।

এখন কথা হচ্ছে, বয়স হওয়ার প্রমাণ কি?
বয়স প্রমাণের উপায় হচ্ছে, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী, আমাদের দেশে বিয়ে করার জন্য পাত্র পাত্রীকে বয়স প্রমাণের জন্য,

  •  জন্ম নিবন্ধন সনদ,
  •  জাতীয় পরিচয় পত্র,
  •  মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট,
  •  জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট,
  •  প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট অথবা
  •  পাসপোর্ট

আইনগত দলিল হিসাবে বিবেচিত হইবে। উপরিউক্ত যেকোনো একটি দলিলের ভিত্তিতে যদি কোন ছেলে বা বিয়ের পাত্র বয়স ২১ এবং মেয়ে বা বিয়ের পাত্রী বয়স ১৮ প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আইনত ভাবে তাদের বিয়েতে কোন বাঁধা নেই।
এখন দেখা যায় যে, স্কুল কলেজে পড়াশোনা বা অন্য যেকোনো স্তরের ছেলে মেয়েই যখন একে অন্যের প্রেমে পড়ে, তখন দেখা যায় যে তারা বয়সের বাঁধার কারণে কাবিননামা রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না বলে আইনজীবীর মাধ্যমে এফিডেভিট করে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কথিত ‘কোর্ট ম্যারেজ’ সম্পন্ন করে থাকে।
শুধুই যে ছেলে মেয়ে গোপনে বিয়ে করার সময় কোর্ট ম্যারেজ করে থাকে তা কিন্তু নয়, অনেক সময় পারিবারিক ভাবে বিবাহ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, বাবা মা ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন যে ছেলের এখনো ২১ হয়নি বা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়ের এখনো ১৮ হয়নি। তখন ওনারাও নিরুপায় হয় হুজুর ডেকে বিবাহ পড়িয়ে থাকলেও কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন করাতে পারেন না বলে আইনজীবীর মাধ্যমে এফিডেভিট করে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কথিত ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করিয়ে থাকেন।

অনেকেই আবার আইনজীবীর মাধ্যমে এফিডেভিট করে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কথিত ‘কোর্ট ম্যারেজ’ না করিয়ে কাজীর মাধ্যমেই বিবাহ সম্পন্ন করান। কাবিননামাতে সকল তথ্য এন্ট্রি করান, বর কণের স্বাক্ষর নিয়ে থাকেন, কিন্তু ফাইনালি ওদের বয়স ২১/১৮ না হওয়া পর্যন্ত কাবিননামাটি রেজিস্ট্রেশন করান না। যখনি বর কণে উভয়েই ২১ এবং ১৮ বছরের যোগ্যতা অর্জন করে, তখন তাদের কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন করিয়ে থাকেন।

তবে, যারা শুধু আইনজীবীর মাধ্যমে এফিডেভিট করে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কথিত ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করিয়ে থাকেন, তারা অবশ্যই কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিবেন, অন্যথায় বিবাহের বৈধতা নিয়ে জটিলতায় পড়তে হবে। উত্তরাধিকার থেকে শুরু করে হজের মত গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপে কাবিননামা বা ম্যারেজ সার্টিফিকেট আবশ্যক হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, কাবিননামা ব্যতীত আপনার ম্যারেজ সার্টিফিকেটও পাবেন না।
পরিশেষে বলা চলে, কোর্ট ম্যারেজ যেহেতু রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী কোন বিবাহ নয়, তাই কাজির মাধ্যমে কাবিননামা রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন করাই উত্তম পন্থা।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.