Maintenance to the parents

পিতা-মাতার ভরণপোষণের মামলা করতে হয় যেভাবে

পারিবারিক আইন

গত কয়েক পর্বে আমরা পিতা মাতার ভরণপোষণ নিয়ে বিস্তারিত ধারনা পেয়েছি। পিতা মাতার ভরণপোষণ প্রদান না করলে বা কেউ বাঁধা প্রদান করলে তা আইনত অপরাধ, যার শাস্তি ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড; অনাদায়ে অনধিক ৩ মাসের কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। উক্ত আইনে ভরণপোষণ বলতে আমরা বুঝবো, খাওয়া দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা, বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদান।
এখন কোন সক্ষম এবং সামর্থ্যবান সন্তান যদি তার বাবা মাকে ভরণপোষণ না দেয় বা কোন সন্তানের স্বামী/স্ত্রী/ছেলে/মেয়ে/নিকট আত্মীয় কেউ তার বাবা মাকে ভরণপোষণ দিতে বাঁধা প্রদান করে, তাহলে ঐ সন্তান বা সন্তানের স্বামী/স্ত্রী/ছেলে/মেয়ে/নিকট আত্মীয়ের বিরুদ্ধে পিতা মাতার ভরণপোষণ আইনের অধীনে মামলা করার পদ্ধতি বা নিয়ম কি?

পিতা মাতার ভরণপোষণ আইনের অধীনে অভিযোগ দায়ের করবেন যেভাবে:
পিতা মাতার ভরণপোষণ আইনের ৭ ধারার ১ উপধারা অনুসারে, পিতা মাতার ভরণপোষণ আইনের অধীনে কোন অভিযোগ দায়ের করতে হলে সেটি অবশ্যই ১ম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করতে হবে। কেননা, উক্ত আইন অনুসারে কেবল এই দুই আদালতকেই এই আইনের অধীন অপরাধ গুলো বিচার করার এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে।

আবার, পিতা মাতার ভরণপোষণ আইনের ৭ ধারার ২ উপধারা অনুসারে, লিখিত অভিযোগ ব্যতীত কোন আদালতই এই আইনের অধীন কোন অভিযোগ আমলে নিবেন না। তাই, যদি কোন সন্তান তার বাবা-মা বা দাদা-দাদী বা নানা-নানীকে ভরণপোষণ না দেয়, তবে তার বিরুদ্ধে ১ম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে আদালত উক্ত অভিযোগ আমলে নিবেন এবং বিচারকার্য পরিচালনা করবেন।
অর্থাৎ, মহানগর এলাকার মধ্যে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর এবং মহানগর এলাকার বাহিরে ১ম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর অভিযোগ দায়ের করতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে, কোন বাবা মা আদালতে গিয়ে তার সন্তানের বিরুদ্ধে ভরণপোষণ না দেওয়ার কারণে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেন, সন্তানরা ভরণপোষণ না দেওয়ার অপরাধে অপরাধী হলে তাদের শাস্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু, যদি লিখিত অভিযোগের পর সন্তানদের মাঝে হুঁশ ফিরে আসলে তখন যদি তারা আপোষ করতে চায় তখন কি হবে?
যেহেতু পারিবারিক ব্যাপার এবং বাবা মায়ের সাথে সন্তানের বিরোধ, তাই এই বিরোধগুলোকে আপোষযোগ্য করা হয়েছে। মামলা হওয়ার পরও যদি উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষে বিরোধ মীমাংসা করতে ইচ্ছুক হয়, তবে সেটি করতে পারবে।

এজন্য পিতা মাতার ভরণপোষণ আইনের অধীন কোন মামলা আদালতে দায়ের করা হলে, আদালত উক্ত অভিযোগ আপোষে নিষ্পত্তির জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে চেয়ারম্যান বা মেম্বার, পৌরসভা পর্যায়ে মেয়র বা কাউন্সিলর, সিটি কর্পোরেশন পর্যায়ে মেয়র বা কাউন্সিলর বা অন্য কোন ব্যক্তি যাকে আদালত উপযুক্ত মনে করেন, তার কাছে প্রেরণ করতে পারেন। আদালত যদি আপোষে নিষ্পত্তির জন্য চেয়ারম্যান বা মেম্বার বা মেয়র বা কাউন্সিলর বা অন্য কারো নিকট কোন অভিযোগ প্রেরণ করেন, তখন যার কাছে অভিযোগ পাঠানো হয়েছে তিনি অভিযোগের বাদী বিবাদী উভয় পক্ষকে তাদের অভিযোগ, আত্মপক্ষ সমর্থন, যুক্তিতর্ক ইত্যাদি শুনানির সুযোগ দিয়ে বিরোধটি নিষ্পত্তি করবেন। চেয়ারম্যান বা মেম্বার বা মেয়র বা কাউন্সিলর বা অন্য যাকেই আদালত দায়িত্ব দিবেন, তিনি অভিযোগ নিষ্পত্তি করলে তা আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত বলে গণ্য হবে।

তাছাড়া, এই আইনের অধীনের অপরাধ আমলযোগ্য (আমলযোগ্য অপরাধ: যে অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ ফৌজদারি কার্যবিধির ২য় তফসিল অথবা আপাতত: বলবৎ কোনো আইন অনুযায়ী গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতীত অভিযুক্তকে আটক করতে পারে; অতএব সাবধান) এবং জামিনযোগ্য (ভিন্ন কিছু না ঘটলে আসামী আইনগত অধিকার হিসেবে জামিন পাবেন; সুতরাং রিলেক্স)।
হিন্দিতে একটি কথা আছে যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় যে, ‘কিতাব বা বই পড়লেই বইয়ের লেখককে বুঝতে পারা যায়’। তেমনি আইন পড়লেও আইন প্রণেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সহজেই বুঝতে পারা যায়।
পিতা মাতার ভরণপোষণ আইন পুরোটা পড়ার পর আমরা অন্তত একটি বিষয় বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে, আইন প্রণেতাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তানদেরকে পিতা মাতার প্রতি যত্নশীল করা। সরাসরি কোন কারাবাসের নিধান না রাখা, আর্থিক ক্ষতিপূরণের পরিমাণও ১ লক্ষ টাকার মধ্যে রাখাই কিন্তু ইঙ্গিত দেয় যাতে পিতা মাতার ভরণপোষণে উদাসীন সন্তানের হুঁশ ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি আইন প্রণেতারা একেবারে পারিবারিক সমস্যার গোঁড়ায় গিয়েছেন যা কিনা কপি পেস্ট আইনগুলোতে দেখতে পাওয়া যায় না।
আমাদের সমাজে পিতা মাতার ভরণপোষণ দিতে সন্তানরা যতটা উদাসীন বা নিজ থেকে যতটা অস্বীকার করে তারচেয়ে অনেকাংশে বেশি তারা বাধাপ্রাপ্ত হয় নিজের স্ত্রী বা স্বামী বা ছেলে বা মেয়ে বা নিকট আত্মীয় যেমন শ্বশুর, শাশুড়ি, শালা, শালি থেকে শুরু করে দেবর, ননদের মত লোকজনদের দ্বারা। উক্ত আইনে সন্তানদের পাশাপাশি এদেরকেও যেহেতু আইনের আওতায় আনা হয়েছে, এতে অন্তত অনেকেই নিজে যেমন নিজের বাবা মায়ের ভরণপোষণ প্রদানে সচেতন হবে তেমনি অন্যকে বাঁধা দিবে না অন্যের বাবা মাকে ভরণপোষণ প্রদান করতে।

তবে, যে সমস্যাটি আইনে আলোচনা করা হয়নি সেটি হচ্ছে, এক সন্তানের সামর্থ্য বেশি আরেক সন্তানের সামর্থ্য কম, সেক্ষেত্রে কে কত দিবে এই বিষয় নিয়েও অনেক পরিবারে বিরোধ লেগেই থাকে। যার সামর্থ্য বেশি সে বেশি দেওয়া উচিত এই দাবী যেমন যৌক্তিক; তেমনি যার সামর্থ্য কম সে তখন একেবারে না দেওয়ার ধান্ধায় থাকে, এটি অপ্রিয় হলেও সত্যি।
তবে হ্যাঁ, আইন করে সব সমাধান করা যায় না, এটি যেমন ঠিক, তেমনি শাস্তি দিয়েও ভালোবাসা জন্মানো যায় না এটিও বাস্তবিক; অন্তত জন্মদান করা বাবা মায়ের প্রতি।
আমাদের দেশে সরকারী কিছু বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে, হচ্ছে কিছু বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রমও। আপনি আমি যদি আমাদের বার্ধক্য ঐ বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে কাটাতে চাই তাহলে তো বাড়তি কিছুই বলার নেই, কিন্তু যদি বার্ধক্যে আমরা বৃদ্ধাশ্রমে যেতে না চাই তাহলে আমরা জীবিত থাকতে যেন আমাদের নিজেদের এবং আমাদের আশপাশের কোন বাবা মাকেও বৃদ্ধাশ্রমে যেতে না হয়। ভালো থাকুন দুনিয়ার সকল বাবা মা।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.