হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন

হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন করবেন যেভাবে (খরচসহ)

পারিবারিক আইন

সাতচল্লিশে (১৯৪৭) দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত আমাদের পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা যত আইন করে গেছে,সেগুলো একযোগে পুরো ভারতের (ব্রিটিশ আওতাভুক্ত) উপরই কার্যকর ছিল। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর একই আইনই ভারত ভারতের নামে আর পাকিস্তান পাকিস্তানের নামে এডপ্ট করে নিয়েছে যার পরম্পরায় আমরাও একাত্তরে আমাদের নামে নামকরণ করে নিয়েছিলাম। সবগুলো আইনের আগেই দেশ নাম বসানো হয়েছে তা কিন্তু নয়। তবে, আইনের পরিধিতে আমরা নিজ নিজ দেশের নাম বসিয়ে দিয়েছে বরাবরই। তবে, এখন আমাদের ৩ দেশেই আইনের সংখ্যা কিন্তু সমান নয়। প্রয়োজনে সবাই নতুন আইন বানিয়েছে। আর লম্বা না করে সংক্ষেপে বলছি, ভারত যেহেতু হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ, তাদের দেশে হিন্দুদের জন্য পার্সোনাল/ব্যক্তিগত আইন অনেক হয়েছে এবং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বেশ যুগোপযোগী আইন করেছে যেখানে কিনা আমাদের দেশে হিন্দুদের জন্য তেমন কোন পার্সোনাল আইনই করা হয়নি। আজও আমাদের দেশে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদের কোন আইন নেই, অথচ ভারতে রয়েছে। আক্ষেপটা এই জায়গায় যে, ভারতের তৈরি অনেক আইনের বেশ প্রভাব বা অনুপ্রেরণা রয়েছে আমাদের আইনে, কিন্তু হিন্দুদের জন্য আইন করার বেলায় বেশ উদাসীন আমরা। তবে, ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ বা ‘মন্দের ভালো’ হচ্ছে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২। এই আইনের আগে হিন্দুরা বিবাহ করলেও তার কোন আইনানুগ ভিত্তি তৈরির উপায় ছিল না। এখন অন্তত নিজেদেরকে স্বামী স্ত্রী হিসেবে প্রমাণ দেওয়ার জন্য হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন কাজে আসবে। একটা আইনি ডকুমেন্ট তৈরির পথ অন্তত তৈরি হল। আসুন কিভাবে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন করবেন, আজ সেই সম্বন্ধে জানবো।

হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২ এর ৩ ধারার ১ উপধারা অনুসারে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং হিন্দু রীতিনীতি তথা শাস্ত্র অনুসারে সম্পাদিত বিবাহ সমূহকে নিবন্ধন করা যাবে। এখানে নিবন্ধন করতেই হবে এই ধরনের বাধ্যবাধকতার পরিবর্তে বলা হয়েছে নিবন্ধন করা যাবে অর্থাৎ আপনি ইচ্ছা করলে নিবন্ধন করতে পারবেন আবার ইচ্ছা অনুযায়ী নিবন্ধন না করে থাকতে পারবে। কেননা উক্ত আইনের ৩ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে যে, ৩ ধারার ১ উপধারায় যা কিছু বলা থাকুক না কেন, কোন হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পন্ন হওয়া বিয়ে এই আইনের অধীন যদি নিবন্ধন করা না হয় তাহলে উক্ত বিয়ের বৈধতা ক্ষুণ্ণ হবে না। অর্থাৎ এই আইনের ৩ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পন্ন হওয়ার বিবাহ সমূহ নিবন্ধন করা যাবে, কিন্তু কেউ যদি এই আইনের অধীন উক্ত বিবাহ নিবন্ধন না করে, শুধু হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পন্ন করে তাহলে উক্ত বিয়ের বৈধতা ক্ষুণ্ণ হবে না। অর্থাৎ নিবন্ধন না করলেও বিয়ের বৈধতা অটুট থাকবে। এখানে নিবন্ধনের চাইতেও হিন্দুশাস্ত্র বা হিন্দু রীতি নীতি অনুসারে সম্পন্ন হওয়াটাকেই বেশী জোর দেওয়া হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে আপনি কেন আপনার বিবাহ নিবন্ধন করবেন?

কেন আপনি আপনার বিবাহটি নিবন্ধন করবেন, এর উত্তর আমরা হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২ এর ৩ ধারার ১ উপধারায় ৪টি শব্দের মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছে। ৩ ধারায় বলা হয়েছে, হিন্দু বিবাহের ‘দালিলিক প্রমাণ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে’ হিন্দু বিবাহ নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিবন্ধন করা যাবে। এখানে ‘দালিলিক প্রমাণ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে’ বলতে আপনি বুঝতে পারছেন কেন একটি হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন করা যেতে পারে বা করা উচিত। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী আপনার বিয়ে করা বউকে নিয়ে হানিমুনে গেলেন কক্সবাজার। হোটেলে পুলিশ আপনাদের সন্দেহ করল, তখন আপনি ডকুমেন্ট হিসেবে কি দেখাবেন?



বাধ্যতামূলক না করাটার সাথে আমি একমত হতে পারছি না, কেননা মুসলিম বিবাহ কাজীর মাধ্যমে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক, কাজী রেজিস্ট্রি খাতায় নিবন্ধন না করলে শুধুমাত্র এফিডেভিটের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হয় না। হিন্দু আইন অনুসারে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক নয়, তবে কারো প্রয়োজন হলে সে নিবন্ধন করতে পারবে। এমন নরম হলে তো কেউই প্রয়োজন না হওয়ার আগ পর্যন্ত করবে না। যাই হোক, এখন কথা হচ্ছে, যাদের নিবন্ধন করার আগ্রহ নেই শুধু ধর্মীয় রীতি-নীতি বিবাহ সম্পন্ন করে সন্তুষ্ট থাকতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য এই আর্টিকেলটি নয়। বরং যারা চাচ্ছেন তাদের বিবাহ একটি আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বীকৃতি পেয়ে থাকুক, তারাই কেবল সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে। যদিও এখানে কোনভাবেই যে কোন ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসারে বিবাহ সম্পন্ন করাকে খাটো করে দেখা হচ্ছে না। কিন্তু বর্তমান যুগে আইনানুগ স্বীকৃতির ব্যাপারটি এতটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আমার মতে প্রত্যেকটি ধর্মীয় নীতি অনুসারে বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পরেও দুইজনের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি সরকারের তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধ থাকা উচিত। কেননা সারাবিশ্বেই এখন মৌখিক চুক্তির কোন ভিত্তি নেই। বিবাহ যেহেতু একটি দেওয়ানি চুক্তির মতোই, সে ক্ষেত্রে সেটিও লিখিত থাকা উচিত এবং সরকারের একটি অথরিটির মাধ্যমে সেটি লিপিবদ্ধ থাকা উচিত যাতে ভবিষ্যতে এই বিয়েকে অস্বীকার করা বা এই বিয়েকে কেন্দ্র করে কোন আইনানুগ অধিকার তৈরি হলে সেটি রক্ষা করার জন্য উক্ত চুক্তিপত্রটি খুঁজে পাওয়া যায় এবং ব্যবহার করা যায়।

চুক্তির কথাই যখন আসলো তখন বলে রাখা ভালো যে, হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২ এর ৫ ধারা অনুসারে একুশ (২১) বছরের কম বয়স্ক হিন্দু পুরুষ বা আঠারো (১৮) বছরের কম বয়স্ক হিন্দু নারী কোনমতেই এই আইনের অধীন বিবাহ সম্পন্ন করতে পারবেন না তথা নিবন্ধন করতে পারবেন না। এটা বলা বাহুল্য যে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে এখন পুরুষের জন্য ২১ আর নারীর জন্য ১৮, বিয়ের নূন্যতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে; সেটি এই আইনেও অনুসরণ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কে বা কারা এই নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারবে?

প্রথমত হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২ এর ৬ ধারা অনুসারে যেকোনো পক্ষ অর্থাৎ বিবাহের যে কোন পক্ষ বর বা কনে আবেদন করলে বিবাহ নিবন্ধন করা যাবে। প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করবে কার কাছে?

আবেদন করতে হবে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধকের বরাবর। সরকার সিটি কর্পোরেশন এরিয়ার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় এবং সিটি কর্পোরেশনের বাহিরে প্রত্যেক উপজেলায় একজন করে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধক নিয়োগ দিবে। আপনি যদি আপনার বিবাহ নিবন্ধন করতে চান, সেক্ষেত্রে আপনাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে আপনার এলাকায় হিন্দু বিবাহ নিবন্ধক কোথায় রয়েছে, তারপর আপনাকে তার বরাবর আবেদন করতে হবে। তখন তিনি ওনার নিয়মকানুন মেনে আপনাদের বিবাহ নিবন্ধন করে দিবেন। আমরা চেষ্টা করব বাংলাদেশের যতজন হিন্দু বিবাহ নিবন্ধক তথা ‘হিন্দু কাজী’ রয়েছেন তাদের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার ভবিষ্যতে কোনভাবে আপনাদের সুবিধার্থে আমাদের ওয়েবসাইটে সংরক্ষণ করে রাখার জন্য।
এখন একটি প্রশ্ন যা করতে লজ্জা লাগলেও সবাই মনে মনে এই প্রশ্নটিই হয়তো ভাবছেন যে, হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন করতে কত টাকা খরচ হয় বা সরকারি ফি কত?

হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন ফি সম্বন্ধে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২ এর ৭ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার সময়ে সময়ে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন ফিস নির্ধারণ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে সেটা যেকোনো সময় সরকার পরিবর্তন করতে পারবেন, বাড়াতে বা কমাতে পারবেন। এই আর্টিকেলটি আমি যখন লিখছি তখন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস চলছে, আজ আমি একজন হিন্দু বিবাহ নিবন্ধকের সাথে ফোনে কথা বলে জানতে পেরেছি যে, এই মুহূর্তে সরকারি ফ্রি হচ্ছে এক হাজার (১০০০/-) টাকা।

তাহলে আপনি আপনার বিবাহটি এই আইনে নিবন্ধন করতে চাইলে বিবাহ নিবন্ধক এর কাছে গিয়ে আপনাদের বিবাহ নিবন্ধন করে নিতে পারবেন। আর যদি আপনারা পূর্বে বিবাহ সম্পন্ন করে না সরাসরি নিবন্ধকের কাছে যান, সে ক্ষেত্রে প্রথমে ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করে বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে তারপর নিবন্ধন করা তবে সে ক্ষেত্রে বিবাহ নিবন্ধক বাড়তি সার্ভিস চার্জ দাবী করতে পারেন (সেটা স্বাভাবিকও বটে)। আমরা পরবর্তী আরেকটি পর্বে কেন হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন করা উচিত এবং হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন না করলে আপনি কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন সেই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করব। আজকে এই পর্যন্তই।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.