হিন্দু ডিভোর্স

হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়া

পারিবারিক আইন

অত্যন্ত দুঃখের সাথে শুরুতেই প্রথমেই বলে রাখি যে, হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্ভব নয়। একবার বিয়ে হয়ে গেলে আর ডিভোর্স বা তালাক সম্ভব না। তবে, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্যি যে হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ না থাকার ফলে একজন হিন্দু স্ত্রী মনে মনে তার স্বামীর মৃত্যু কামনা করা ছাড়া আর বৈধ কিছুই করতে পারবে না। কেননা, বাংলাদেশে একজন হিন্দু স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বামীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক যত প্রকারের নির্যাতনই হোক না কেন, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবেন না। কিন্তু, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী যখন বিধবা হবে, তখন বিধবা বিবাহ আইনের অধীনে হিন্দু বিধবা নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারবেন। যদিও শুনতে বিষয়টিতে নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়, কিন্তু এটাই কঠিন বাস্তবতা। তবে, নিষ্ঠুরতা যে স্ত্রীর উপর কম হয় না তা কিন্তু নয়। তাছাড়া, আপনি একজন হিন্দু পুরুষ, আপনি জানেন যে আপনার স্ত্রী কোন মতেই আপনার জীবদ্দশায় আপনাকে তালাক দিতে পারবে না, পারবে না অন্য কোথাও বিয়ে করতে, তখন আপনি স্বভাবতই বেপরোয়া হয়ে পড়বেন, যতই আপনি নিরীহ হয়ে থাকেন না কেন। কথায় আছে, হাতে বন্দুক পেলে নিরীহ মানুষের চোখ যায় পশু পাখীর দিকে। তেমনি, আইন যখন আপনাকে প্রশ্রয় দেয়, তখন আপনি তার অপব্যবহার করতে ছাড়বেন না, এটাই বাস্তবতা।

বিষয়টা বুঝতে আরেকটা উদাহরণ দেই চলুন। বাংলাদেশে গত দশকের শেষ দিক থেকে ফেসবুক ব্যবহার শুরু হলেও এই দশকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে এসে পৌঁছেছে। জনপ্রিয়তা তো আর এমনি এমনি আসেনি, এসেছে এর জনবহুল ব্যবহারকারীর কারণে। এই জনবহুল ব্যবহারকারীরা অর্থাৎ আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন না থাকলে আমরা যে কেমন আচার আচরণ করতাম, তা এখনি মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার নিউজ পোষ্টের নীচের কমেন্ট পড়লে বা ভিন দেশী কোন অভিনেত্রীর পোষ্ট করা কোন ছবির নীচের কমেন্ট গুলো পড়লেই টের পাবেন। অপ্রিয় সত্য কথা হচ্ছে, স্বাধীনতা সবাই চর্চা করতে জানি না, বেশীরভাগই আমরা বর্বর হয়ে উঠি।

কথিত আছে যে, ‘বই পড়লে ঐ বইয়ের লেখক ব্যক্তিগত জীবনে কেমন সেটা বুঝতে পারবেন’। তেমনি আইন পড়লেই বুঝতে পারবেন আইন প্রণেতাদের উদ্দেশ্য কি? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে হুকুমের গোলাম বানিয়ে রাখতেই নারীর স্বাধীনতাকে খর্ব করার জন্যই বিয়েতে নারীকে একেবারে পণ্য বানিয়ে রাখা হয়েছে।
যদিও অনেকেই ভাববেন যে, তালাককে সমর্থন করে কেন এতো সাফাই গাওয়া হচ্ছে, যেখানে ইসলাম ধর্মেও তালাককে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হিসেবে দেখা হয়। তাছাড়া, পরিবারতন্ত্র টিকিয়ে রাখতেও তো তালাককে না বলা উচিত। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে যে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ডিভোর্স বা তালাকের হার ৩৯%, অর্থাৎ ১০০ টি বিয়ের মধ্যে ৩৯ টি বিয়েই ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাহলে কেন আমরা হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ নেই বলে এতো সমালোচনা করছি?

তালাক কোন ধর্ম, বর্ণ, রাষ্ট্র বা নীতিতেই সমর্থন যোগ্য নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত বিয়ের উদ্দেশ্য সাধন হচ্ছে। আমি মানি যে, তালাকের পরে স্বামী নতুন করে স্ত্রী পাবে, স্ত্রীও নতুন করে স্বামী পাবে কিন্তু যদি তাদের কোন সন্তান থেকে থাকে সে আর বাকি জীবনে একই সাথে বাবা মাকে পাবে না। ব্রোকেন পরিবারের সন্তানদের অদেখা একটা চাপা কান্না যারা দেখেছে, কেবল তারাই জানে তালাক কতোটা নিকৃষ্ট। কিন্তু, সেই সন্তানদের চাপা কান্না থেকে বাঁচাতে তালাককে এড়িয়ে যখন এখন মা যে কিনা কারো স্ত্রী নামের নির্যাতনের লক্ষবস্তু, তার কান্না নিয়ে কারোই কোন মাথাব্যথা নেই। শুধু সন্তানের দিকে তাকিয়ে বা অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে যারা স্বামীর অন্যায় অবিচার সহ্য করে যায়, তাদের কষ্ট গুলো যদি খুব কাছ থেকে দেখেন, তখন মনে হবে ঐ নিকৃষ্ট কাজটি কারো কারো জন্য আশীর্বাদ।



এতো হতাশার মাঝেও একটি আশার আলো হচ্ছে, হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ না থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু শর্তে স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকার সুযোগ রয়েছে। খুব সংক্ষেপে শর্ত গুলো আলোচনা করার চেষ্টা করবো যেগুলোর ভিত্তিতে এক হিন্দু স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকতে পারবে, শর্তগুলো নিম্নরূপ:

  • স্বামী যদি খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয় এবং যার ফলে তার সাথে থাকাটা অনিরাপদ। এই কারণটাই সবচেয়ে বেশি আমাদের সমাজে।
  • স্বামী পুনরায় বিয়ে করলে। নারী সবকিছু শেয়ার বা ভাগাভাগি করতে পারলেও স্বামীকে কখনোই অন্য স্ত্রীলোকের সাথে শেয়ার করতে পারবে না। যার ফলে সেপারেশন অনিবার্য। স্বামী পুনরায় বিয়ে না করে যদি উপপত্নী রাখে, সেক্ষেত্রেও স্ত্রী সেপারেশন করতে পারবে।
  • স্বামী এমন কোন রোগে আক্রান্ত যার ফলে স্ত্রী আর স্বামীর সাথে থাকা সম্ভব নয়, তখন স্ত্রী সেপারেশনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। বিষয়টি একটু অমানবিক বলে মনে হলেও ধরুন আপনার মেয়ে বা বোনের স্বামী এইডস রোগে আক্রান্ত, আপনি কি আপনার বোন বা মেয়েকে আর ঐ সংসারে পাঠাবেন, যেখানে কিনা আপনার মেয়ে বা বোনেরও এইডস হওয়ার সর্বোচ্চ সুযোগ রয়েছে?
  • স্বামী যদি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে।
  • তাছাড়া বিবিধ অন্য কোন যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে যদি স্ত্রীলোকটি আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারে যে, তার সেপারেশন দরকার, আর আদালত সন্তুষ্ট হলে তবেই কেবল আদালত সেপারেশনের জন্য অনুমতি দিতে পারেন।

এখানে উল্লেখ্য, সেপারেশনে থাকাবস্থায় স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য স্বামী। এখানেও আইনটির যথেষ্ট দুর্বলতা পরিলক্ষিত। স্ত্রীলোকটি ভরণপোষণও পাবেন ঠিকই, কিন্তু প্রত্যেকেরই একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত জৈবিক চাহিদা থাকে। ভরণপোষণ দিয়ে তো স্ত্রীলোকটি বাকী জীবনটা কাটাতে পারবে না। শুধু ভরণপোষণ পাবেন, কোথাও বিয়ে করতে পারবে না, তখন আপনাআপনিই সমাজের অবক্ষয়ের জন্য যে অনৈতিক কাজগুলো রয়েছে, স্ত্রীলোকটি ঝুঁকবে সেইসব দিকে। এটা অনেকটাই বাধ্য হয়ে। তাই, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের কথা ভেবে বিবাহ বিচ্ছেদ আইন পাস করা উচিত, যেখানে সেপারেশনের যে শর্ত গুলো রয়েছে, সেই শর্তগুলোর কোন একটি ভঙ্গ হলে স্ত্রী লোকটি আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে আবেদন করতে পারবে। আদালত তখন বিচার বিবেচনা করে স্ত্রীলোকটি বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দিতে পারেন। নাহলে একদিকে যেমন একবিংশ শতাব্দীতে এসেও হিন্দু নারী পরাধীন দাসীর ন্যায় জীবন যাপন করবে, তেমনি অন্যদিকে সেপারেশনে থাকা সিঙ্গেল স্ত্রীলোকদের জৈবিক চাহিদার তাড়নায় সমাজে নৈতিক অবক্ষয় নেমে আসবে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.