নাবালক সম্পত্তি বিক্রি আইন

নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি: পর্ব ৩

উত্তরাধিকার আইন

আগের দুই পর্বে আমরা নাবালকের সম্পত্তি কি এবং কোন পরিস্থিতিতে নাবালকের বিক্রি করা যাবে সেই সম্বন্ধে আলোচনা করার পর এই পর্বে আমরা কে বা কারা নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে সেই সম্বন্ধে আলোচনা করা হবে।
নাবালকের অভিভাবক বলতে আমরা অনেকেই আবার আইনগত অভিভাবক এবং কার্যত অভিভাবক এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারি না। আইনগত অভিভাবক হচ্ছে, যে অভিভাবক নাবালকের স্বার্থে নাবালকের শরীর এবং সম্পত্তির দায়িত্ব নিবেন এবং প্রয়োজনবোধে সম্পত্তি বিক্রি, বন্ধক, যেকোনো ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, হস্তান্তর ইত্যাদি করতে পারেন। পক্ষান্তরে কার্যত অভিভাবক হচ্ছে, যে অভিভাবক স্বেচ্ছায় নাবালকের শরীর বা সম্পত্তির দায়িত্ব নিতে পারেন কিন্তু নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন না এবং তিনি যদি কোনভাবে সম্পত্তি হস্তান্তর করে থাকেন তবে তা বাতিল বলে গণ্য হয়। সাধারণত অভিভাবক বাবার বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে তবে তারা ব্যর্থ হলে মায়ের বংশের আত্মীয় না সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। আইনগত অভিভাবকের ক্ষেত্রে পিতা ব্যতীত বাকি সকলেই আদালত কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত হবেন; কেননা পিতা স্বাভাবিক অভিভাবক। এবার চলুন জানি, কারা নাবালকের আইনগত অভিভাবক।

আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, সাবালকত্ব আইন ১৯৭৫ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোনো ব্যক্তির ‘নাবালক’। চুক্তি আইন ১৮৭২ অনুযায়ী কোন নাবালক ব্যক্তি চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না। জমি ক্রয় বিক্রয় এক ধরনের চুক্তি। আর চুক্তি আইন অনুযায়ী নাবালক চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না। ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনের ৩৫ ধারা মতে, কোন নাবালক দলিল সম্পাদন করতে পারবে না। নাবালকের পক্ষে তার বাবা বা মা বা অভিভাবক দলিল সম্পাদন করতে হবে। এখন আমরা জানবো বাবা, মা বা অন্যান্য অভিভাবক কিভাবে নাবালকের অভিভাবক হয়ে নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি, বন্ধক বা হস্তান্তর করতে পারবেন।

নাবালকের বাবা

নাবালকের সম্পত্তি নাবালকের পিতা কারো কোন প্রকারের ওজর আপত্তি বা অনুমতি ব্যতীতই বিক্রি করতে পারবেন। কেননা, নাবালকের পিতা নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক। ১২ ডিএলআর ৪৩৩ মামলার রায়ে বলা হয়েছে যে, নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক আদালতের অনুমতি ছাড়াই নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারে নাবালকের পিতা মৃত হলে বা অবর্তমানে অন্য যেকোনো অভিভাবককে নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করতে হলে অবশ্যই প্রথমে আদালত উক্ত অভিভাবককে নিযুক্ত করতে হবে।
যদিও আমরা জানি যে পিতা হচ্ছে নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক, আর স্বাভাবিক অভিভাবক আদালতের কোন প্রকারের অনুমতি ব্যতিরেকে নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করতে পারে এবং পিতা যতদিন জীবিত রয়েছে ততদিন পর্যন্ত পিতা নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক তার স্বত্বেও অর্থাৎ পিতা জীবিত থাকা অবস্থাতেও অন্য কেউ চাইলে নাবালকের অভিভাবক হওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন। এই মুহূর্তে আমরা দেখার চেষ্টা করবো, কখন নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক পিতা জীবিত থাকা অবস্থাতেও অন্য কেউ নাবালকের অভিভাবক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন।



  • স্বাভাবিক অভিভাবক এর মৃত্যু হলে যেমন অন্যান্য অভিভাবকেরা নাবালকের অভিভাবক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন ঠিক তেমনি স্বাভাবিক অভিভাবক যদি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রেও অন্যান্য অভিভাবক চাইলে নাবালকের অভিভাবক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন।
  • তাছাড়া নাবালকের অভিভাবক হওয়ার জন্য মা-বাবা দাদা-দাদী নানা-নানী ইত্যাদি আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যদি মতবিরোধ সৃষ্টি হয় সে ক্ষেত্রেও নাবালকের অভিভাবক নিশ্চিত করার জন্য আদালত নাবালকের অভিভাবক নিয়োগ করে দিতে পারেন।
  • আবার, যদি একজন নাবালকের অভিভাবক হওয়ার জন্য একের অধিক আবেদনকারী থাকে সেই ক্ষেত্রে কে অভিভাবক হবে এটা নিশ্চিত করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে।

নাবালকের মা

আপাত দৃষ্টিতে মাকে আমরা বাচ্চার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অভিভাবক মানলেও আইনত মা কিন্তু স্বাভাবিক অভিভাবক নন। মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে, সন্তানের কাস্টাডির ব্যাপারেও মায়ের রয়েছে লিমিটেড অধিকার। সন্তান কার কাছে থাকবে এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় তখন আপনাকে যেতে হবে মুসলিম পারিবারিক আইনে। মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে, ছেলে সন্তান ৭ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকতে পারবে এরপর সে স্বাভাবিক অভিভাবক বাবার কাস্টাডিতে চলে যাবে। আর মেয়ে সন্তানের বেলায় সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে, তারপর বাবার কাছে চলে যাবে। সাধারণত, বাবা মায়ের মধ্যে তালাক হয়ে গেলে সন্তান কার কাছে থাকবে এই বিরোধ নিষ্পত্তিতে উক্ত বিধানটি মান্য করা হয়। কিন্তু, নাবালক সন্তানের সম্পত্তি বিক্রি বা বন্ধকের ক্ষেত্রে কিন্তু এই ধরনের কোন বয়স সীমা নেই। এখানে একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র বাবাকে। মা যদি অভিভাবক হয়ে নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করতে চায়, তখন মাকে অবশ্যই আদালতের অনুমতি নিতে হবে।

অন্যান্য অভিভাবক

বাবা মা ছাড়াও আরও অনেক নিকট আত্মীয়ও একজন নাবালকের অভিভাবক হতে পারেন। একজন নাবালকের জন্য কারা কারা অভিভাবক হতে পারেন, তাদের একটা লিস্ট নিম্নে দেওয়া হবে যার মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো কারা ইচ্ছে করলে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে কোন নাবালকের অভিভাবক হতে পারেন। লিস্টটি নিম্নরূপ:

  • পিতা
  • পিতার উইল দ্বারা নিয়োগকৃত ব্যক্তি
  • দাদা ও দাদার উইল দ্বারা নিয়োগকৃত ব্যক্তির
  • আপন/সহোদর ভাই
  • রক্তের সম্পর্কের ভাই
  • আপন/সহোদর ভাইয়ের ছেলে
  • রক্তের সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে
  • পিতার আপন/ সহোদর ভাইয়ের ছেলে
  • পিতার রক্তের সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে

কিছু টোটকা

  • মাতা নাবালকের অভিভাবক যিনি নাবালক এর পক্ষে নাবালকের কল্যাণে নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারে।- ১৪ ডিএলআর ৫০৬
  • একজন ব্যক্তির বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নাবালক থাকবেন, তবে যে নাবালকের শরীর বা সম্পত্তি বা উভয়ই আদালত কর্তৃক নিযুক্ত কোন অভিভাবকের তত্ত্বাবধায়কের অধীনে আসে সে নাবালকের বয়স ২১ বছর না হওয়া পর্যন্ত তিনি নাবালক থাকবেন, সাবালক হিসেবে গণ্য হবেন না।– দি মেজরিটি এক্ট, ১৮৭৫

 

[ বাকি পর্বগুলোঃ পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৪ ]

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.