ভাতিজী ও চাচা সমান সম্পত্তি

ভাতিজী কখন চাচার সমপরিমাণ সম্পত্তি পেতে পারে?

উত্তরাধিকার আইন

আমরা সাধারণত জানি যে, কোন ব্যক্তির যদি একটি মাত্র ছেলে সন্তান থাকে, হোক তিনি পুরুষ না মহিলা অর্থাৎ, বাবা কিংবা মা, যে কারো পুরো সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক হতে হলে সন্তানকে অবশ্যই ছেলে সন্তান হতে হবে। মেয়ে সন্তানের বেলায় বাবা মায়ের পুরো সম্পত্তির একক অংশীদার উত্তরাধিকারসূত্রে হওয়া সম্ভব হয় না। একটি মেয়ে তার বাবার মায়ের সম্পত্তির অর্ধেক মালিকানা অর্জন করতে পারে, যদি সে একমাত্র কন্যা সন্তান হয়ে থাকে; যার ফলে বাকি অর্ধেক সম্পত্তি বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে একাধিক কন্যা সন্তানের বেলায় পুরো সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ মেয়েদের কাছে থাকছে, বাকি একভাগ বাহিরে চলে যাচ্ছে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে যে, একমাত্র ছেলে সন্তানই পুরো সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে ভোগ করতে পারে। কিন্তু প্রত্যেকটা আইনের একটা ব্যতিক্রম থাকে, সরাসরি ব্যতিক্রম না থাকলেও কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ধর্মী কোন উদাহরণ থেকে থাকে। আজকে আমরা তেমনি একটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করব যেখানে আমরা দেখানোর চেষ্টা করব আপনার চাচা বা জেঠার একটি মাত্র কন্যা সন্তান আর ওই কন্যা সন্তান আপনার চাচা বা জেঠার পুরো সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করছে উত্তরাধিকারসূত্রে, হেবা বা দান সূত্রে নয়। তাহলে, আপনারা এখন জানতে যাচ্ছি যে, চাচাতো বোন বা জেঠাতো বোন একাই যেভাবে চাচা বা জেঠার পুরো সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করছে।

মজার বিষয় হচ্ছে, কিছু দিন আগে আমার এক ফুফার কল্যাণে এই বিষয়টি আমার নলেজে আসলো। এসি ল্যান্ডের অফিস থেকে তিনি একটি চিঠি পেয়েছেন। বলা বাহুল্য, তিনি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। শিক্ষিত মানুষ হয়েও অফিশিয়াল কোন চিঠি, বিশেষ করে আদালত বা প্রশাসনিক কোন দপ্তর থেকে চিঠি আসলে আমাদের দেশের অনেক মানুষ ঘাবড়ে যায়। অথচ চিঠিটি পড়ার পর তিনি নিজেই বুঝতে পারলেন যে, সেটা আর কিছু নয়, একটি খতিয়ান সংশোধনের বিষয়ে ওনার আপত্তি আছে কিনা জানার জন্য এসি ল্যান্ড তলব করেছেন। মূল বিষয় হচ্ছে, উনার এক কাজিন অর্থাৎ চাচাতো বোন খতিয়ান সংশোধনের জন্য মামলা করেছিলেন এবং আদালতের রায়ের মাধ্যমে তিনি এসি ল্যান্ড অফিসে নিজের নামে খতিয়ান সংশোধন করতে চেয়েছেন, এসিল্যান্ড অফিস ওনাকে চিঠি দিয়েছেন, ওনার কোন আপত্তি রয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য। যদি আপত্তি থাকে তিনি যাতে উল্লেখিত তারিখে গিয়ে এসি ল্যান্ড অফিসে সেটি জানান।



মূলত, মামলাটি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা হয়েছিল। মামলাটি দায়ের করেছিলেন ওনার চাচাতো বোন। ওনার চাচা উক্ত চাচাতো বোনকে জন্ম দেওয়ার কিছুদিন পরেই মৃত্যুবরণ করেন। শোক সামলাতে না পেরে মাও অকালে চলে যান। তখন ওই চাচাতো বোনকে কোলে পিঠে করে মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমার ঐ ফুফার বাবা-মা। কোলে পিঠে করে মানুষ করে যখন বিবাহ দেয়া হয় তারপরে স্বামীর বদৌলতে তিনি তার পৈত্রিক সম্পত্তি দাবি করেন। যেহেতু ওনার বাবা-মাকে জন্ম দেওয়ার কিছুদিন পরে মারা গিয়েছিল এবং তখন ওনার দাদা জীবিত ছিল সেই ক্ষেত্রে দাদা থেকে ওনার বাবা কোন সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সুযোগ পান নি, তাছাড়া ওনার বাবা নিজে কোন সম্পত্তি ক্রয় করেন নি। এমতাবস্থায় ফুফার ফ্যামিলি ওই চাচাতো বোনকে নিয়ে শহরে বসবাস করার কারণে গ্রামে যখন সরকারী জরীপ এসেছিল তখন ওই এতিম কন্যাটির জন্য কোন সম্পত্তি বরাদ্দ না রেখে আমার ফুফার বাবা চাচারা যারা যারা জীবিত ছিলেন তাদের নামে জমি রেকর্ড করে নিয়েছিলেন।
যেহেতু ফুফার কাজিন এতিম ছিল এবং তার বাবা নিজস্ব কোন সম্পত্তি ছিল না, তার উপর দাদা জীবিত অবস্থায় বাবা মারা গিয়েছিল সে ক্ষেত্রে বাবা উত্তরাধিকারসূত্রে কোন সম্পত্তি পেতে পারেন নি। অর্থাৎ লা ওয়ারিশ প্রথা অনুসারে তিনি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল এবং রেকর্ড সেই অনুসারে করা হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি ১৯৬১ সালে লা ওয়ারিশ প্রথা বাতিল করা হয়, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ অনুসারে। যখন ঐ এতিম মহিলাটি এ আইন সম্বন্ধে জানতে পারলেন, তখন তিনি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে খতিয়ান সংশোধনের জন্য মামলা করলেন এবং তিনি যে ওনার দাদার মৃত ছেলের ওয়ারিশ সেই অনুসারে যা যা ডকুমেন্টস সাবমিট করা দরকার তার সবগুলো সাবমিট করলেন। আদালত সকল ডকুমেন্ট যাচাই-বাছাই করার পরে ওই খতিয়ান সংশোধন করার জন্য নির্দেশ দেন এবং ওই এতিমের বাকি দুই চাচা যা সম্পত্তি পেয়েছিল তিনি তাদের সমান অংশ পেয়েছিলেন। ভাতিজী যখন একাই চাচার সম্পত্তি পেতে পারে তার একটা নজির আমরা এই মামলার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম। যদিও আমরা এর আগে বহুবার লা ওয়ারিশ প্রথা বাতিল নিয়ে আলোচনা করেছি এবং দেখানোর চেষ্টা করেছি যে দাদা জীবিত অবস্থায় বাবা মারা গেলে উত্তরাধিকারসূত্রে নাতি-নাতনিরা তাদের বাবা মা জীবিত থাকলে যতটুকু সম্পত্তি পেতো ঠিক ততটুকুই পাবে। কিন্তু, এর মাধ্যমে ভাতিজী মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও একজন পুরুষের সমান সম্পত্তি পাচ্ছে তাও আবার পুরো খতিয়ান সংশোধন করে, আইনের আশ্রয় নিলে আইন যে আপনাকে ন্যায় বিচার দিবে তা কিন্তু এই ঘটনাটি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

যদিও পাঠকদের জানার সুবিধার্থে এই অভিজ্ঞতাটুকু আর্টিকেল এর মাধ্যমে তুলে ধরলাম, তারপরও এখন অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে, এটা কিভাবে সম্ভব? আসলে এটা ওই আইনের একটা দুর্বলতাও বলা যেতে পারে আবার যদি ঐ সময়কার আইন প্রণেতারা এই উদ্দেশ্যে করে থাকেন যে এতিম সন্তান কে একটু বেশি সম্পত্তি দেওয়া হোক সেটাও হতে পারে। কিন্তু মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৪ ধারায় যেটা বলা হয়েছে সেটা হুবহু তুলে দিচ্ছি, “In the event of the death of any son or daughter of the propositus before the opening of succession, the children of such son or daughter, if any, living at the time the succession opens, shall per stirpes receive a share equivalent to the share which such son or daughter, as the case may be, would have received if alive.”
বাংলা করলে দাঁড়াচ্ছে, কারো উত্তরাধিকার হিসেব হওয়ার আগেই অর্থাৎ কেউ মারা যাওয়ার আগেই(যেহেতু মারা গেলেই উত্তরাধিকার চালু হয়) যদি তার ছেলে বা মেয়ে মারা যায়, তাহলে যখন উত্তরাধিকার চালু হবে তখন যদি ঐ ছেলে বা মেয়ের সন্তান জীবিত থাকে তাহলে ঐ মৃত ছেলে বা মেয়ে জীবিত থাকলে যে সম্পত্তি পেতো তা তাদের সন্তান পাবে।
অর্থাৎ, আপনার দাদা বা দাদী, নানা বা নানী জীবিত অবস্থায় যদি বাবা বা মা মারা যায়, তাহলে দাদা-দাদী, নানা-নানী মারা যাওয়ার সময় যদি বাবা-মা জীবিত থাকতো, তারা যতটুকু সম্পত্তি পেতো, আপনি ঠিক ততটুকু পাবেন। এবার আপনি একজন হলেও পাবেন, আপনি মেয়ে হলেও পাবেন। এই আইনে আলাদা করে মেয়েদের জন্য কিছু বলা হয়নি। তাই, ভাতিজী বা ভাগিনীও এই আইনের আওতায় চাচা বা মামার সমান সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারে। আবার, মৃত বাবা মায়ের পুরো সম্পত্তি মেয়ে একাই মালিক হতে পারে।
আশা করি বুঝতে পেরেছেন, ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.