মুসলিম আইনে দত্তক সন্তানের উত্তরাধিকার

উত্তরাধিকার আইন

পৃথিবীতে আমরা প্রত্যেকেই নিজের লিগ্যাসি তৈরি করে যেতে চাই। আমার মৃত্যুর পর কেউ একজন আমার নামটি বাঁচিয়ে রাখবে, সারাজীবনে আমার অর্জিত সম্পদ গুলো কেউ একজনকে আমি রেখে যেতে পারবো ভোগ দখলের জন্য, বৃদ্ধ বয়সে আমি কোন একজনের কাঁধে ভর করে চলতে পারব কোন ধরনের চিন্তা ছাড়াই। যদিও শুধুমাত্র নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে আমরা পৃথিবীতে নিজের সন্তান জন্ম দিয়ে থাকি, কিন্তু এটা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন প্রোডাকশন। আমরা কারো হাত ধরে এসেছি আবার আমাদের হাত ধরেই কেউ একজন পৃথিবীতে আসবে। তাছাড়া দুনিয়াতে আবাদি করার জন্য হলেও এই প্রোডাকশন প্রয়োজন রয়েছে। আজ পৃথিবীতে প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ রয়েছে, প্রত্যেকেই যদি দুনিয়াতে আর কোন সন্তান জন্ম দিবে না এই মানসিকতা বহন করে তাহলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যেই পৃথিবী জনশূন্য হয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্যই পৃথিবীতে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সন্তানের জন্ম হচ্ছে, নতুন নতুন বাবা-মা তৈরি হচ্ছে। আমরা এমন বলতে শুনি যে, একজন পুরুষ মানুষ পরিপূর্ণতা লাভ করে যখন সে বিবাহ করে এবং একজন নারী তখনই পরিপূর্ণ হয় যখন সে সন্তান জন্ম দিতে পারে, অর্থাৎ মা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কোন কৃত্রিম সমস্যা ছাড়াও শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সমস্যার কারণেও অনেক নারী-পুরুষ সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হয়ে থাকে। কৃত্রিম বললাম এই কারণে যে, অনেকেই হয়তো বা কোনো দুর্ঘটনার কারণে একটি স্থায়ী সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে সন্তান জন্মদান বা ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। না হলে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ভাবে কোন একটি সমস্যার কারণে সন্তান জন্মদানে পুরুষ বা নারী যে কেউই ব্যর্থ হতে পারেন, আর্টিকেলটি শুরুই করতে চাচ্ছি তাদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করে, সাথে শুধু একটা কথাই বলতে চাই, আল্লাহ যেটা যার জন্য ভালো মনে করেছেন সেটাই করেছেন, তাই এর জন্য কখনো আফসোস করবেন না।

নিঃসন্তান দম্পতি সন্তানের প্রতি তাদের আবেগ ভালোবাসার যখন কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না তখন তারা দত্তক নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই ক্ষেত্রে সাধারণত আশেপাশের পরিচিত কারো সন্তান দত্তক নেওয়া কিংবা হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান দত্তক (পড়ুন ক্রয়) নেওয়ার প্রচলনই বেশি। বাহিরে যদিও বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে সন্তান দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে, আমাদের দেশে এখনো বিষয়টি গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান কারণে ওইখানে বিভিন্ন আইনি কাগজপত্র তৈরি করার মাধ্যমে এবং নিঃসন্তান দম্পতিরা দত্তক নেওয়ার মতো যোগ্যতা রাখেন কিনা সেটি প্রমাণ করার পরেই শুধুমাত্র সন্তান দত্তক নিতে পারেন। কেননা অনেক সময় দেখা যায় সন্তান দত্তক নেওয়ার নাম করে সন্তানকে পাচার করে দেওয়ার ঘটনা একেবারে বিরল নয়। তাই যাচাই-বাছাই করে তারপর সন্তান দত্তক দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু ওই ধরনের বিষয় সেভাবে প্রচলিত নেই, সে ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সন্তানের প্রকৃত বাবা-মা আর দত্তক নেওয়া দম্পতি নিজেদের মধ্যে চুক্তির ভিত্তিতে সন্তান দত্তক নিতে পারে। এক্ষেত্রে আইনানুগ প্রক্রিয়া করে দত্তক নিলেই ভালো হয়, সেই বিষয়ে আমরা ভবিষ্যতে কিভাবে দত্তক সন্তানকে আইনি প্রক্রিয়া দত্তক নেওয়া যায় সে বিষয়েও আলোচনা করব। আজকে শুধুমাত্র আমরা আলোচনা করব দত্তক সন্তানের সম্পত্তিতে অধিকার নিয়ে।



ইসলাম ধর্ম অনুসারে সন্তান দত্তক নেওয়ার বিষয়ে কোন প্রকার বাধা না থাকলেও মুসলিম উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের যে পদ্ধতি সেখানে দত্তক সন্তানের জন্য কোন ধরনের সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হয়নি। আমাদের প্রিয় হযরত মুহাম্মদ (সা:) নিজে দত্তক নিয়েছিলেন, সেই হিসেবে দত্তক নেওয়ার বিষয়টি ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। তবে দত্তক সন্তানের জন্য মুসলিম আইন অনুসারে কোন ধরনের উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার নেই। কিন্তু নিঃসন্তান দম্পতি যখন কোন সন্তানকে দত্তক নেয় তখন তাদের ইচ্ছেই থাকে যে, তাদের মৃত্যুর পরে এই দত্তক সন্তানই তাদেরই লিগ্যাসি বহন করবে, সে ক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে তাদের জীবদ্দশায় তার সন্তানকে সম্পত্তি লিখে দেওয়া। এক্ষেত্রে তারা হেবা করতে পারবে না, কারণ তাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই, এক্ষেত্রে তারা করতে পারে সাব কবলা দলিল। যদিও এই ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় দত্তক সন্তানকে সকল সম্পত্তি লিখে দেওয়ার পর দত্তক সন্তানের প্রকৃত বাবা মা এসে ওই সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা করে। এই কারণেই আমরা আরেকটি আর্টিকেলে লিখব, যেখানে আমরা দেখানোর চেষ্টা করবো, কিভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় সন্তান দত্তক নেওয়া যায়, তাহলে প্রকৃত বাবা-মা চাইলে তাদের সন্তানকে একবার দত্তক দিবে আর সুযোগ বুঝে সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য দত্তক বাতিক করে ওদের সন্তান হিসেবে ভবিষ্যতে দাবি করতে না পারে।

বাস্তব জীবনে কেস স্টাডি করলে দেখা যায় যে, অনেক নিঃসন্তান দম্পতির দত্তক নেওয়ার পরে আবার তাদের নিজেদের ঔরসজাত সন্তান জন্ম নেয় অথবা কোন দম্পতির শুধুমাত্র ছেলে কিংবা শুধু মেয়ে অর্থাৎ কোন দম্পতির এক বা একাধিক ছেলে সন্তান রয়েছে, কিন্তু কোন মেয়ে নেই সেক্ষেত্রে তারা মেয়ে দত্তক নিতে পারে আবার এক বা একাধিক মেয়ে সন্তান রয়েছে সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র ছেলে সন্তানের অভাব মোচন করার জন্য ছেলে সন্তান দত্তক নিতে পারে। যার ফলে অনেক সময় বিপত্তি দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে সন্তানকে সামান্য কিছু সম্পদ হিসাব করে দেওয়া যেতে পারে বা বাকি ওয়ারিশদের সম্মতি নিয়ে উইল করে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো হচ্ছে জীবিত অবস্থায় দত্তক সন্তানকে সম্পত্তি দেওয়ার ইচ্ছে যদি থেকে থাকে তাহলে সাফ কবলা দলিল করে লিখে দেওয়া, প্রয়োজনে সেটি সন্তানের অগোচরে রাখাটাই ভালো। যেটা তাদের মৃত্যুর পরে দত্তক সন্তানকে জানানো যেতে পারে অথবা অনেক সময় একটা কাজ করা যেতে পারে সেটা হচ্ছে, ব্যাংকের কোন একাউন্টে নমিনি করে দেওয়া যেতে পারে এবং একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সন্তানের নামে রেখে দেওয়া যেতে পারে। যেভাবেই হোক, দত্তক সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করে তার ভবিষ্যতের জন্য সম্পত্তি রেখে যেতে হবে যাতে তাকে অন্যের কাছে হাত পাততে না হয়; কেননা সে উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পত্তি পাবে না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন, তারপরও কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে আমাদেরকে ই-মেইল করে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.