ওয়ারিশ

মৃত ওয়ারিশের উত্তরাধিকার

উত্তরাধিকার আইন

এই আর্টিকেলটি পড়ার সময় অর্থাৎ পড়তে পড়তে আপনি অনেকবার বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন বা বিব্রত হতে পারেন স্তবকে স্তবকে। অনেকে আবার শিরোনাম পড়েই বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছেন ইতিমধ্যে। কারণটা একদম স্বাভাবিক, আমরা সাধারণত মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনা করি। মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে উত্তরাধিকার আইন অনুসারে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে, তাই আমরা সচেতনও বটে। কিন্তু মৃত ওয়ারিশের উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে আমরা সাধারণত আলোচনা করি না, কারণ এই বিষয়টি সম্বন্ধে আমাদের সঠিক ধারণা নেই। মৃত ওয়ারিশ বলতে আসলে কারা এরা, সেটা আমরা বুঝতে সক্ষম নই কখনো কখনো। শহুরে কেউ এই অণুচ্ছেদ পড়লেও এর সার্থকতা বুঝতে হয়তো সক্ষম নাও হতে পারেন, কিন্তু এই অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তু নিয়ে গ্রাম কিংবা পৌরসভা পর্যায়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা-সমালোচনা চলে কিন্তু আমরা আজকে এই অনুচ্ছেদে পর্যালোচনা করব। সাথে অনেকগুলো চলমান অস্পষ্টতা কাটিয়ে আলোর পথ দেখার চেষ্টা করবো।

আমাদের পবিত্র আল-কোরআন হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি বণ্টনের হিসাবটি সরাসরি আল কোরআনের সূরা নিসাতে বর্ণিত রয়েছে। একজন ব্যক্তি যখন তার সম্পত্তি রেখে মারা যাবে তখন তার জীবিত ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের বিষয়ে মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
এখানে মৃত কে?-যার সম্পত্তি বণ্টন করা হবে।
কাদের মাঝে বণ্টন করা হবে?- তার জীবিত ওয়ারিশদের মধ্যে।



এই ‘জীবিত’ শব্দটাই আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুলে যাই, আমরা ধরে নেই তার সকল ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন হবে। যার ফলে এই ছোট্ট একটি ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমাদের সমাজে অনেক সালিশে অনেক সমস্যার ভুল সমাধান হচ্ছে, হয়ে গিয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়ত হবে, তার উপর ইতিমধ্যে অনেক সমাধানযোগ্য সমস্যা কিন্তু আজ আদালতে মামলা উঠে গেছে আর পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক নষ্টের বিষয়ে আজ না হয় আর না-ই বললাম। কিন্তু, এখানে একটা বিষয় আমরা যদি একটু ঠাণ্ডা মাথায় শব্দ থেকে শব্দ বুঝে পড়ার চেষ্টা করি তাহলে আমাদের এই বিভ্রান্তি থাকার কথা নয়। একজন ব্যক্তি মারা গেছে, তার যেসব জীবিত উত্তরাধিকার রয়েছে তাদের মাঝে সম্পত্তি বণ্টন হবে। এখন একটা ব্যক্তি মারা যাওয়ার সময় তার বাবা যদি জীবিত না থাকে তাহলে কি আমরা কখনও তার মৃত বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি কতটুকু পাবে এই নিয়ে কোনো চিন্তা করি?- না। অর্থাৎ, মৃত ব্যক্তির মৃত বাবা তার সম্পত্তি পাবে কিনা এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোন ধরনের জটিলতা তৈরি হয় না। কিন্তু, কখন তৈরি হয় জটিলতা, চলুন উদাহরণ দিচ্ছি। একটা অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ে মারা গেলো বা একটা ভাইয়ের ছেলে নাই শুধু মেয়ে রয়েছে, তাহলে তার মেয়ে এবং স্ত্রীকে সম্পত্তি দেওয়ার পর কিছু অবশিষ্ট অংশ রয়েছে যেগুলো তার ভাই বোনদের কাছে যাবে, সে ক্ষেত্রে সেখানে যদি দুইটা ভাইয়ের মধ্যে একটা ভাই জীবিত থাকে, আরেকজন আরও আগেই মারা গিয়ে থাকে, তাহলে কি পূর্বেই মারা যাওয়া ব্যক্তির কি সদ্য মারা যাওয়া ব্যক্তির থেকে সম্পত্তি পাবে?- জি না। কারণ?

কারণ, যখন একজন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টনের হিসাব করা হচ্ছে, সেই মৃত ব্যক্তির যারা উত্তরাধিকার রয়েছে তারা কেউ যদি তার আগেই মারা গিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সে কোন সম্পত্তি পাবে না। মৃত্যুর সময় শুধুমাত্র যারা জীবিত ছিল তারাই উত্তরাধিকার হিসেবে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে অংশ পাবে।

উপরের চার্টটির দিকে তাকান, ধরুন আমিরুল, জাহাঙ্গির, সোহেল ৩ ভাই। আমিরুল অবিবাহিত অবস্থায় মারা গিয়েছে। এখন, তার সম্পত্তির বণ্টন প্রক্রিয়া চলছে। ধরে নিন, আমিরুলদের কোন বোন নেই, আর বাবা মাও মৃত। এই ক্ষেত্রে, আমিরুলের রেখে যাওয়া সম্পত্তি শুধুমাত্র তার ভাইদের মাঝে বণ্টন করা হবে। এখন, ভাই হচ্ছে ২ জন, জাহাঙ্গির আর সোহেল। এই ক্ষেত্রে আমিরুলের আগেই জাহাঙ্গির মারা গিয়েছে। আমিরুল যখন মারা গিয়েছে তখন শুধুমাত্র সোহেল জীবিত আছে। এখন, জাহাঙ্গিরের ছেলেদের (হাবীব, কবির) দাবী হচ্ছে তাদের চাচা আমিরুলের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে তাদের বাবার ভাই হিসেবে হক রয়েছে এবং তাদের বাবার অবর্তমানে তারা এই হকের পাওনাদার। অন্যদিকে, সোহেলের দাবী তার ভাই আমিরুল যখন মারা গিয়েছে তখন শুধুমাত্র সোহেল একা জীবিত ছিল, তাহলে শুধুমাত্র সোহেলই ভাইয়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে, কেননা মৃত ওয়ারিশ উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি পায় না। এখন এতটুকু পড়ে আর এই দুই পক্ষের যুক্তির মধ্যে কোনটা আপনাকে কনভিন্স করতে পেরেছে?

আপনি যদি উপরের অংশটি ভালো করে বুঝে থাকেন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই সোহেলের যুক্তিতেই আপনাকে কনভিন্স হতে হবে। কেননা, আমিরুল যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কেবলমাত্র সোহেলই জীবিত ছিল আর আমরা এতক্ষণে এটা বুঝতে পেরেছি যে শুধুমাত্র জীবিত ওয়ারিশরাই উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরের পুত্রদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এখানে একটি কথা রয়েছে, সেটি হচ্ছে যদি জাহাঙ্গিরের মত সোহেলও আমিরুলের পূর্বে মারা যেত, হাবীব, কবির, সুমন ৩ জনই উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেতো। কারণ, ভাই যদি না থেকে থাকে সে ক্ষেত্রে ভাইয়ের ছেলেদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন হয়ে থাকে। এখন আপনি আবার প্রশ্ন করতে পারেন যে এখানেও তো সোহেলকে দেওয়ার পর হাবিব কবিরকেও ভাইয়ের ছেলে হিসেবে দেয়া যেতে পারতো, কিন্তু না। এক্ষেত্রে আপনাকে মাথায় রাখতে হবে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে একই সাথে দুই ডিগ্রি আত্মীয় সম্পত্তি পাবে না। ভাই যদি সম্পত্তি পেয়ে থাকে তাহলে ভাইয়ের পুত্র বাদ যাবেন এবং নিকটাত্মীয় থাকলে দূরবর্তী আত্মীয় অবশ্যই বঞ্চিত হবে।
উল্লেখ্য, এখানে ভাইদের কথা বলা হলেও বোনদের উপস্থিতিতেও একই নীতি অনুসরণ করা হবে। শুধুমাত্র, ভাই বোন উভয়ই থাকলে ২:১ নীতি প্রযোজ্য হবে। আশা করি বুঝতে সক্ষম হয়েছে, তারপরও কারো কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদেরকে ইমেইলে জানাতে পারেন, আমি আরও সহজতর করে ভবিষ্যতে লেখার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.