ট্রেড ইউনিয়ন

ট্রেড ইউনিয়ন কি, কেন, কিভাবে?

দেওয়ানি আইন শ্রম আইন

ট্রেড ইউনিয়ন শব্দটার সাথে আমরা প্রায় সকলেই পরিচিত। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন আসলে কি এবং এর কাজই বা কি এই সম্বন্ধে আমাদের অনেকের ধারণা আবছা আবছা। আসুন আজ আমরা জানবো, ট্রেড ইউনিয়ন আসলে কি, কাদের নিয়ে গঠিত, কি কাজ করে এবং এর রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া নিয়ে।
ট্রেড ইউনিয়ন বলতে, শ্রম আইন মোতাবেক গঠিত এবং রেজিস্ট্রিকৃত মালিক বা শ্রমিকদের কোন সমিতি বা সংঘ যেটি গঠিত হয়েছে মূলত মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে বা শুধু মালিকদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতে বা যেকোনো ব্যবসা / বাণিজ্য পরিচালনার উপর নিয়ন্ত্রক শর্ত তৈরি বা আরোপ করার জন্য। এ তো গেলো ট্রেড ইউনিয়ন, আবার যদি দুই বা ততোধিক ট্রেড ইউনিয়ন এক সাথ হয়ে ফেডারেশন গঠন করে, তবে সেটিও আবার ট্রেড ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হবে।
ট্রেড ইউনিয়নের কাজ কি?- এটা নিয়ে অনেকেই অনেক মত দিলেও একটা মামলার রায়ে সেটিকে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে তার সদস্যদের স্বার্থ উন্নয়ন করা এবং এর লক্ষ্য অর্জনে মালিকের সঙ্গে ব্যবসা করা নয়। এটি স্পষ্ট করা হয়েছে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বনাম বিআই ডব্লিউটিএ (BIWTA) ঘাট শ্রমিক ইউনিয়ন ১৯৮২ বি এল ডি (এডি) ৮৩= বিসিআর ১৯৮৩ (এডি) ৩৯১, মামলার রায়ে।

 

ট্রেড ইউনিয়নকে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কেননা, অ-রেজিস্ট্রিকৃত ট্রেড ইউনিয়ন বা রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে গেছে এমন ট্রেড ইউনিয়ন কোন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন করতে হলে, এর সভাপতি এবং সম্পাদকের স্বাক্ষরে সংশ্লিষ্ট এলাকার রেজিস্টার অব ট্রেড ইউনিয়ন এর কাছে দরখাস্ত করতে হবে। দরখাস্তের সময় যাবতীয় কাগজপত্র ছাড়াও ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের জন্য যেসব বিষয়াদি জরুরীঃ
• ট্রেড ইউনিয়নের নাম ও ঠিকানা;
• ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের উদ্দেশ্য;
• গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, সংশোধন ও বাতিলের পন্থা
• ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পন্থা এবং ইহাতে কোন ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য নহে এই মর্মে ঘোষণা দিয়া দরখাস্ত না করলে এর সদস্য হতে পারবেন না- এই মর্মে স্পষ্ট বিধান।
• ট্রেড ইউনিয়নের তহবিলের উৎস এবং উক্ত তহবিল কি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে তার বর্ণনা
• ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যগণের তালিকা সংরক্ষণ এবং এর কর্মকর্তা ও সদস্য কর্তৃক উহা পরিদর্শনের পর্যাপ্ত সুবিধা
• ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সদস্যগণ কর্তৃক এর কর্মকর্তা নির্বাচনের পন্থা এবং কর্মকর্তাগণের কার্যকালের মেয়াদ যাহা কোন ক্ষেত্রেই দুই বৎসরের বেশী হবে না।
• কর্মকর্তাগণের সংখ্যা যা বিধি দ্বারা নির্ধারিত ৫ জনের কম ও ৩৫ জনের বেশি হবে না।
• ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তাগণের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশের পদ্ধতি।
• ট্রেড ইউনিয়নের গঠনতন্ত্র কর্তৃক নিশ্চিত কোন সুবিধা কোন সদস্য কর্তৃক পাওয়ার অধিকারী হওয়ার জন্য শর্ত এবং কোন সদস্যের উপর জরিমানা অথবা বাজেয়াপ্তির আদেশ প্রদানের শর্ত।
• ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাহী কমিটি এবং সাধারণ সদস্যগণের সভা আহ্বান যা নির্বাহী কমিটির ক্ষেত্রে প্রতি ৩ মাসে অন্তত একবার এবং সাধারণ সদস্যগণের ক্ষেত্রে প্রতি বৎসরে অন্তত ১ বার হতে হবে।

আরও কিছু আনুষঙ্গিক ফরমালিটিজ বা আনুষ্ঠানিকতার পর রেজিস্টার অব ট্রেড ইউনিয়ন যদি উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে দরখাস্তকারী ট্রেড ইউনিয়নকে রেজিস্ট্রেশন তথা নিবন্ধন দিতে পারেন। রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পর উক্ত ট্রেড ইউনিয়নের কাজ হবে, তাদের গঠনতন্ত্র অনুসারে তারা যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য সমূহ বাস্তবায়ন করা। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নই সাধারণত বেশি হয়ে থাকে, সে হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ হবে শ্রমিকদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কাজ করা, তবে সেটা কোন মতেই যেন মালিক পক্ষের সাথে ব্যবসায়ের পর্যায়ে চলে না যায়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বনাম বি আই ডবলিও টি এ ঘাট শ্রমিক ইউনিয়ন ১৯৮২ বি এল ডি (এডি) ৮৩= বিসিআর ১৯৮৩ (এডি) ৩৯১ মামলায় রায় মাথায় রেখে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। কেননা, রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার যেমন শর্তাবলী রয়েছে, রেজিস্ট্রেশন বাতিলেরও প্রক্রিয়া শ্রম আইন উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।

রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পরও অনেক ট্রেড ইউনিয়ন আবার তাদের রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন হারায় তথা বাতিল হয়ে যায়। কয়েকটি কারণে একটি ট্রেড ইউনিয়ন তার রেজিস্ট্রেশন হারাতে পারে; তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুলো হল:
• যদি রেজিস্ট্রেশন বাতিলের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন নিজে দরখাস্ত করে।
• ট্রেড ইউনিয়নটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়
• ট্রেড ইউনিয়নটির প্রতারণা অথবা কোন তথ্যের মিথ্যা বর্ণনার মাধ্যমে রেজিস্ট্রি হাসিল করে থাকে
• ইউনিয়নটি তার গঠনতন্ত্রের মৌলিক কোন বিধান লঙ্ঘন করে থাকে।
• ইউনিয়নটি কোন অসৎ শ্রম আচরণ করে থাকে
• ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা মোট শ্রমিক সংখ্যার ৩০% এর নীচে নেমে গেলে
• ট্রেড ইউনিয়নটি শ্রম আইনের কোন বিধি বিধান লঙ্ঘন করে থাকলে।

মোটামোটি এই কয়টা কারণে একটি ট্রেড ইউনিয়ন তার নিবন্ধন হারাতে পারে। রেজিস্ট্রেশন বাতিলের এই প্রক্রিয়াটি অবশ্য বাস্তবায়ন করবে শ্রম আদালত। ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হলে যে অভিযোগের ভিত্তিতে আবেদন করা হবে , সেই অভিযোগটি সৃষ্টির ৩ মাসের মধ্যে শ্রম পরিচালক কর্তৃক শ্রম আদালতে দরখাস্ত করতে হবে। ৩ মাসকে এখানে তামাদি হিসেবে ধরা হয়েছে, অভিযোগর কারণ সৃষ্টির ৩ মাস অতিবাহিত হওয়ার আগে, অর্থাৎ কজ অফ একশনের ৩ মাসের মধ্যেই শ্রম আদালতে দরখাস্তের মাধ্যমে অভিযোগ করতে হবে।
শ্রম পরিচালকের দরখাস্তের ভিত্তিতে যদি শ্রম আদালত কোন ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেয়, তবে শ্রম আইনের ১৯১ ধারার বর্ণনা অনুসারে, ট্রেড ইউনিয়ন শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালে আপীল করতে পারবে, তবে শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসাবে গণ্য হবে। তবে, আপীল ট্রাইব্যুনাল আপীল দায়ের হলে আপীল নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়ন তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। এই হল, স্বল্প ভাষায় শ্রম আইনের অধীনে ট্রেড ইউনিয়নের সৃষ্টি থেকে ধ্বংস পর্যন্ত আইনানুগ প্রক্রিয়া।

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.