সুমি একজন মেধাবী কলেজ শিক্ষার্থী, তার জীবন যেমন পড়াশোনার মাঝেই কাটছে, ঠিক তেমনই তার পরিবারের কিছু সমস্যার জন্য মাঝেমাঝে চিন্তিতও থাকে সে। সুমির মা রোকসানা বেগমের নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে কিছু জমি রয়েছে, যা সুমির বাবা নিজের টাকায় কিনেছিলেন। এই জমিই হয়ে উঠেছে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু। সুমির বাবা মৃত্যুর পূর্বে চেয়েছিলেন, সুমির মায়ের নামে জমি রেখে পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন। কিন্তু সেই জমির দখল নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে তার চাচা জসিমের সাথে। জসিম দীর্ঘদিন ধরে সুমির মা থেকে জমিটি কম দামে কিনতে চাইছিলেন। কিন্তু মা ও মেয়ে সম্মত না হওয়ায় দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। কয়েকবার কথার মাধ্যমে সমাধান না আসায় গত কিছুদিন আগে জসিম গ্রামের বাড়ির সেই জমির গেটে তালা মেরে দেন। জমির গেটে তালা লাগিয়ে উনি সরাসরি সুমির মাকে ফোন করে হুমকি দেন, বলেন, জায়গা লিখে দিতে হবে এবং কোনোভাবেই এলাকায় না আসতে। সুমির মা আতঙ্কিত হয়ে সুমিকে জানালেন, কারণ তার হাতে জমির দলিল, কাগজপত্র সবই আছে। এই ঘটনার পর সুমি খুব চিন্তায় পড়ে যায় এবং তার পরিচিত একজন আইনজীবীর সাথে এই সমস্যার সমাধান জানতে চায়।
আইনজীবীর পরামর্শ: আইনজীবী প্রথমেই সুমিকে আশ্বস্ত করে বলেন, তার মায়ের নামে জমির সমস্ত কাগজপত্র থাকলে কোনোভাবেই জসিম তাদের জায়গা দখল করতে পারে না। তবে এই সমস্যা ঘরোয়া ভাবে সমাধান করার প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত। আইনজীবী বলেন, প্রথমে জসিমের সাথে বসে পারিবারিক ভাবে আলোচনা করে সমাধান করা যেতে পারে। যদি আলোচনায় সমাধান না আসে, তবে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার বা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটি সালিশি বৈঠক আয়োজন করা উচিত। সালিশি বৈঠক হচ্ছে গ্রামের প্রথাগত বিচার ব্যবস্থা, যেখানে নিরপেক্ষ ভাবে উভয় পক্ষের কথা শোনা হয় এবং স্থানীয়ভাবে একটি সমাধান বের করার চেষ্টা করা হয়। তবে, যদি এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান না পাওয়া যায়, তাহলে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। সুমির মা যেহেতু জমির বৈধ মালিক এবং তাদের কাছে জমির সমস্ত বৈধ কাগজপত্র রয়েছে, তারা আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন।
আইনগত ব্যবস্থা: আইনজীবী বলেন, এই ক্ষেত্রে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর ৭ ধারা প্রযোজ্য হতে পারে। এই আইনের অধীনে, যেকোনো ব্যক্তি বৈধ মালিকানা বা দখলের অধিকার ব্যতীত কোনো ভূমি দখলে রাখতে পারবেন না। সুমির মায়ের নামে জমির দলিল রয়েছে এবং সেই অধিকারকে লঙ্ঘন করে জসিম যদি জমি দখল করতে চান, তাহলে তিনি আইনত অপরাধ করছেন।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর ৭ ধারা অনুযায়ী, State Acquisition and Tenancy Act, 1950-এর অধীন হালনাগাদকৃত বলবৎ সর্বশেষ খতিয়ান মালিক বা তার উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা পাওয়া ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ জমি দখল করতে পারে না। যদি জসিম এই নিয়ম লঙ্ঘন করেন, তবে তিনি দুই বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
সুমি এখন তার আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী প্রথমে ঘরোয়া ও স্থানীয় স্তরে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করবে। কিন্তু যদি কোনো সমাধান না আসে, তবে সুমির মা পুরো বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে সমাধান করতে পারেন এবং আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। এইভাবে, জমির বৈধ অধিকার রক্ষা করে জসিমের অন্যায় কার্যক্রম থেকে মুক্তি পেতে পারেন সুমি ও তার পরিবার।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর ৭ ধারা সাধারণ জনগণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি জমির অবৈধ দখল প্রতিরোধ ও দখলদারদের অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। ধারা ৭-এর সহজ ভাষায় বুঝতে নীচে ব্যাখ্যাসহ দেওয়া হলো:
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর ৭(১) ধারার ব্যাখ্যা:
এই উপধারার মূল কথা হলো, আপনি যদি কোনো জমির বৈধ মালিক না হন, তাহলে আপনি সেই জমি দখল করে রাখতে পারবেন না। বৈধ মালিক হবেন তিনি, যার নাম সংশ্লিষ্ট রেকর্ডে বা খতিয়ানে (যা সরকার তৈরি করেছে) আছে। অথবা যদি কেউ উত্তরাধিকারসূত্রে বা অন্য কোনো বৈধ উপায়ে জমি পেয়েছেন, যেমন দলিল বা আদালতের আদেশের মাধ্যমে, তবে তিনিই সেই জমির মালিক হিসেবে স্বীকৃত। অন্যথায়, কেউ সেই জমি দখল রাখতে পারবে না।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর ৭(২) ধারার ব্যাখ্যা:
এই উপধারা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করে দেয়। যদি আপনি বৈধভাবে জমির মালিক হন বা আইনানুগ ভাবে সেই জমি দখলে নিয়ে থাকেন, তাহলে কোনো ব্যক্তি, আদালতের আদেশ ছাড়া, আপনাকে সেই জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে না। আর যদি কেউ জোর করে সেই জমি দখল করতে চায় বা আপনাকে সেই জমিতে ঢুকতে বাধা দেয়, তাহলে সেটাও অবৈধ।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর ৭(৩) ধারার ব্যাখ্যা:
এই উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ প্রথম বা দ্বিতীয় উপধারার নিয়ম ভাঙে, অর্থাৎ জমি দখল করার চেষ্টা করে অথচ সে বৈধ মালিক না হয় অথবা বৈধ মালিককে জমি থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সেটি একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য শাস্তি হলো সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। অর্থাৎ, জমি দখলের চেষ্টা করলে সেই ব্যক্তিকে জেলে যেতে হতে পারে এবং জরিমানাও দিতে হতে পারে।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর ৭ ধারায় একটি শর্তও আছে। যদি কোনো ব্যক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে জমি পেয়ে থাকেন এবং জমির মালিকানা নিয়ে কোনো ভুল রেকর্ড থাকলে তিনি যদি আদালতে মামলা করেন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তার স্বত্ব ঘোষণা করার জন্য আবেদন করেন, তাহলে এই ধরনের মামলা চলমান থাকলে তাকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে না। অর্থাৎ, তিনি বৈধভাবে তার অধিকার প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, তাই তাকে অপরাধী বলা যাবে না।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর ৭ ধারা মূলত জমির অবৈধ দখল প্রতিরোধ করে বৈধ মালিকের অধিকার সুরক্ষা দেয়। যদি কোনো ব্যক্তি জমির বৈধ মালিক না হয়, তাহলে সে সেই জমি দখল করতে পারবে না। আর যদি কেউ বৈধভাবে জমির মালিক হয়, তাকে কেউ জোর করে জমি থেকে সরাতে পারবে না। যারা এই নিয়ম ভঙ্গ করবে, তারা শাস্তি পাবে—দুই বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
এভাবে, এই আইন সাধারণ মানুষকে তাদের জমির অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে এবং অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )