জমির দলিল

জমির দলিলে প্রচলিত শব্দসমূহের অর্থ

জমি-জমার আইন

খতিয়ান: জমি জমার প্রসঙ্গ উঠলেই আমরা প্রায়শই এই শব্দটি শুনে থাকি।আসুন জেনে নেই খতিয়ান সম্বন্ধে, খতিয়ান কি, কেন, কিভাবে?
একটা সীম কার্ড রেজিস্ট্রেশন করা আছে আমার নামে। আমি ঐ সীমটি আপনার কাছে বিক্রি করে দিলাম। এখন, মোবাইল কোম্পানির নথিতে তো আমার নামেই সীমটি রেজিস্ট্রেশন করা। তাই, মোবাইল কোম্পানির নথি থেকে আমার নাম বাদ দিয়ে আপনার নাম বসাতে হবে। তবেই, কোম্পানির তরফ থেকে আপনি সীমটির বৈধ মালিকানা অর্জন করবেন। জমিজমার ক্ষেত্রেও তাই, আপনি আমার কাছ থেকে একটি জমি ক্রয় করলেন, সেই জমির মালিকানা দলিলের মাধ্যমে হস্তান্তর হলেও সরকারি নথিতে তো আমিই মালিক রয়ে গেছি। সেই নথি থেকে আমার নাম বাদ দিয়ে আপনার নাম বসাতে হবে। এই যে ‘সরকারি নথি’তে জায়গার মালিক আমি বললাম, এই সরকারি নথিকেই খতিয়ান বলে।
সময়ে সময়ে জমির পরিমাণ, শ্রেণী এবং মালিকানা যাচাই করতে সরকার যে জরীপ পরিচালনা করে, তাকে রেকর্ড বলে আর রেকর্ডের ফলশ্রুতিতে যা তৈরি হয়, তাই খতিয়ান হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন প্রকারের খতিয়ান: সিএস,আরএস,এসএ,পিএস,এমআরআর, বিএস।

 

চৌহদ্দি: জমি হস্তান্তর দলিলে দেখবেন চৌহদ্দি নামে একটা প্যারা রয়েছে। জমির খতিয়ান, দাগ যেমন জরুরী ঠিক তেমনি চৌহদ্দিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চৌহদ্দি নির্ধারণ করা না থাকলে একটি প্লটে আপনার জমি ঠিক কোন দিকে বা সেটি কি স্কয়ার নাকি লম্বালম্বি, তার কোনটাই বুঝতে সক্ষম হবে না, যা কিনা ভবিষ্যতে আপনার জন্য বিপত্তি ডেকে আনতে পারে। চৌহদ্দি হচ্ছে আপনার সীমানা, আপনি ২ কাঠা জমি ক্রয় করবেন কিন্তু ঐ জমিটির চারপাশে কে বা কারা আছে, এটা নির্ধারণ করে দিলে আপনার জমিটির প্রকৃত অবস্থান আপনি জানতে পারবেন। যখন আপনার জমির পূর্বে কে, পশ্চিমে কে, উত্তরে কে, দক্ষিণে কে আছে এটা নির্ধারিত করা থাকবে দলিলে তাহলে আপনি ক্লিয়ার বুঝতে পারবেন আপনার জমির সীমানা কোন দিক দিয়ে কতটুকু?

পর্চা: পর্চা হচ্ছে, যখন কোন জমির উপর সরকারি জরীপ চলে তখন জরীপ কালে জমির খতিয়ানের যে খসড়া প্রস্তুত করা হয়, তাকেই পর্চা বলা হয়। জরীপ অফিসাররা জরীপ করে যা পেলেন তার হুবহু খতিয়ানে গেজেট আকারে লিপিবদ্ধ করার আগে জমির মালিকদের কারো কোন আপত্তি আছে কিনা সেটা যাচাই করার জন্য একটা মাঠ পর্চা তৈরি করে তার একটা কপি জমির মালিকদের দিয়ে আসেন। পরবর্তীতে জমির মালিকদের কারো কোন আপত্তি থাকলে তারা সেটি যথোপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে উপস্থাপন করলে তখন তা জরীপ অফিসার সংশোধন করে নিবেন।

জে এল নাম্বার: থানা বা উপজেলার মধ্যে যেসব মৌজা বা গ্রাম রয়েছে তাদেরকে পর্যায়ক্রমে ক্রমিক নাম্বার দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে। তাই, মৌজা বা গ্রামের নামের পরিবর্তে যে নাম্বার ব্যবহার করা হয় তাকে জে এল নাম্বার বলে।



শতাংশ/কাঠা: জমি ক্রয় বিক্রয়ে জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় শতাংশে নয়ত কাঠাতে। যদিও শতাংশ এখন বাংলাদেশের সকল স্থানে একচেটিয়া ব্যবহৃত হচ্ছে কেননা একটা সার্বজনীন স্ট্যান্ডার্ড ব্যতীত পুরো দেশে জমিজমার ব্যবস্থাপনাকে সুশৃঙ্খল রাখা সম্ভব না। তাই, রেজিস্ট্রি দলিল গুলোতে জমির পরিমাণকে শতাংশেই লেখা হয়ে থাকে। কিন্তু, ঢাকাস্থ শহরের কিছু অঞ্চলে শতাংশের পরিবর্তে কাঠার হিসেব প্রচলিত। এই নিয়ে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও আসলে দুইটা পরিমাপ দুই স্ট্যান্ডার্ডে এবং জমির পরিমাণেও রয়েছে ভিন্নতা, তাই বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নাই। জমি পরিমাপের সবচেয়ে ক্ষুদ্র এককটি হচ্ছে, স্কয়ার ফুট বা বর্গফুট। ১ শতাংশ= ৪৩৫.৬ বর্গফুট আর ১ কাঠা= ৭২০ বর্গফুট। গ্রাম অঞ্চলে কড়া, গণ্ডা, ক্রান্তির হিসেব এখনো মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু, দলিলপত্র থেকে এই শব্দ গুলোর ব্যবহার একদম কমে গেছে।

খাস জমি: ব্যক্তি মালিকানার বাহিরে যেসব জমি রয়েছে, সেগুলোর মালিক হচ্ছে সরকার। আর সরকারি জমি যখন অব্যবহিত অবস্থায় থাকে, তখন সরকার খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে সেই জমি গুলোকে জনগণের কাছে বন্দোবস্ত দিয়ে থাকে। ঐ জমিগুলোকেই সাধারণত খাস জমি বলা হয়ে থাকে।

আমলনামা: জমিদারের কাজ থেকে জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার পর প্রজার স্বত্ব ও দখল প্রমাণ করার জন্য প্রজাকে যে দলিল প্রদর্শন করতে হয়, তাকে বলা হয় আমলনামা। কোথাও কোথাও একে হুকুমনামা নামেও ডাকা হয়। এটা অনেকটা এখন আমরা সরকারের কাছ থেকে খাস জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার প্রমাণপত্রের মত। অর্থাৎ, জমিদারের কাছ থেকে প্রজার বন্দোবস্ত নেওয়ার দলিলকেই আমলনামা বলে।

এজমালি সম্পত্তি: যখন আপনার ভাই বোন সবাই মিলে আপনার বাবা বা মায়ের সম্পত্তি যৌথভাবে মালিকানা অর্জন করবেন, তখন আপনাদের সম্পত্তিকে এজমালি সম্পত্তি বলা হবে। দলিলে এই শব্দ যদি দেখতে পান, তাহলে বুঝতে পারবেন সেখানে যৌথ সম্পত্তির কথা বলা হয়েছে।

জমা খারিজ: এজমালি সম্পত্তি যখন বুঝেছেন, তখন এজমালি খতিয়ানও বুঝবেন আশা করি। যদি কোন খতিয়ানে একাধিক মালিক থাকে তবে সেই খতিয়ানকে আমরা সহজ ভাষায় যৌথ খতিয়ান হিসেবে আখ্যায়িত করবো। ধরুন, আপনার ভাইবোনদের সকলের সম্মেলিত ভাবে একটি যৌথ খতিয়ান রয়েছে। এখন এই খতিয়ান থেকে আপনি আপনার নাম এবং অংশ আলাদা করতে চাচ্ছেন, তখন আপনার নামে নতুন খতিয়ান সৃষ্টি হবে। এই নতুন খতিয়ান খোলাকে জমা খারিজ বলা হয়ে থাকে।

মৌজা: গ্রামকে দলিলের ভাষায় মৌজা নামে ডাকা হয়।

তসদিক: সাক্ষ্যপ্রমাণ ও কাগজপত্র দ্বারা সত্যতা যাচাই করার নাম তসদিক।

তাছাড়া, সাং মানে ঠিকানা, পিং মানে পিতা, জং মানে জামাই/স্বামী।
আজ এই পর্যন্তই, ভবিষ্যতে আরও কিছু দলিল ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে লেখার চেষ্টা করবো।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.