জমি কেনার সময় কি করবেন

জমি ক্রয়ের আগে ক্রেতার করণীয়: পর্ব ১০

জমি-জমার আইন দেওয়ানি আইন

বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে বাবার উত্তরাধিকাররা বাবার রেখে যাওয়ার সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। মা এবং ছেলে-মেয়েরা বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিজ নামে নামান্তর করে নেয়, নামজারি তথা জমাখারিজের মাধ্যমে। এখন বাংলাদেশে যেহেতু বাবা তথা একজন ব্যক্তিই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির, সেহেতু বাবার মৃত্যুর সময় যদি মা বা ভাইবোন কেউ উপার্জনক্ষম না হয়ে থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে উক্ত সম্পত্তি বিক্রি করে সংসার চালাতে হতে পারে। সংসার চালানোর প্রয়োজন না পড়লেও কারো কোন গুরুতর রোগের চিকিৎসা বা কারো বিয়ে শাদীর সময়ও জায়গা বিক্রির প্রয়োজন পড়তে পারে। তাছাড়া, আরও অনেক কারণেই পিতার মৃত্যুর পর মাতা বা সন্তানদের প্রয়োজনে বা সময় এবং অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পত্তি বিক্রির প্রয়োজন পড়তে পারে। শুধু জমি নয়, যেকোনো ধরনের সম্পদ এমনকি ব্যবসা বাণিজ্যের শেয়ারও বিক্রির প্রয়োজন পড়তে পারে। যারা বিক্রি করবে, তাদের তো কোন সমস্যা নেই, তারা টাকার বিনিময়ে জমি বা সম্পদ ছাড়বে, সমস্যা হচ্ছে যারা কিনবে তাদের জন্য। কেনার সময় যদি অসাবধানতা অবলম্বন করে, তাহলে নাবালকের সম্পদ ক্রয় করে বেকায়দায় পড়তে হতে পারে নির্দ্বিধায়।

যেকোনো প্রয়োজনে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী বা স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামী তার সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য বা অন্য যেকোনো অবশ্যই জরুরী পারিবারিক কোন কারণে সম্পত্তি বিক্রি করতে পারে। যে সম্পত্তির মালিক কিনা নাবালক সন্তান বা সন্তানেরা। আবার কোন কোন সময়, বাবার মৃত্যুতে পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে মায়ের পরিবর্তে বড় ভাইকেও তার নাবালক ভাই বোনদের সম্পত্তি বিক্রি করতে হতে পারে। এই বিষয়টিও আমাদের সমাজে অহরহ ঘটতে দেখা যায়। তো কথা হচ্ছে, বাবা/ মা/ বড় ভাই/ বড় বোন অথবা অন্য যেকোনো ব্যক্তিই নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করুক না কেন, নিয়ম হচ্ছে যথাযথ প্রয়োজন দেখিয়ে আদালতের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারপর বিক্রি করা। কিন্তু, বাস্তবতা ভিন্ন। অনেকেই আদালতের অনুমতি ছাড়াই, খতিয়ান সূত্রে মালিক দেখিয়ে স্ত্রী একাই মৃত স্বামীর সকল সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়, যেখানে কিনা নাবালক সন্তানরা উক্ত খতিয়ানের জমির নতুন বৈধ মালিক। কিন্তু, অজ্ঞতার কারণে হোক বা কখনো কখনো জেনেও না জানার মত করে বিক্রি করে দিচ্ছে আবার কখনো বা যথাযথ কারণ দেখিয়ে আদালতের অনুমতি নিতে পারে না বলে বা পারবে মনে করে আদালতের অনুমতি না নিয়েই নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছে।

তবে বাবা বা মা বা বড় ভাইবোন কেউ চাইলে নাবালক ভাই সাথে থাকা তাদের যৌথ সম্পদ থেকে নিজেদের যতটুকু অংশ বা হিস্যা, তা বিক্রি করতে পারবে। এতে আইনানুগ কোন বাঁধা নেই। আগের পর্ব গুলোতে যেমন দেখেছিলাম যে, অংশীদার বা যৌথ মালিকানা জমিতে একজন মালিক চাইলেই তার অংশ বিক্রি করতে পারবে, সে অনুসারে এখানেও যদি নাবালকের সাথে কোন এজমালি সম্পত্তি থাকে তবে সেক্ষেত্রে সাবালক মালিক চাইলে তার অংশ বাহিরে বিক্রি করতে পারবে।

যেমনটা করা উচিত বা যায়, একজন ব্যক্তি স্ত্রী, সাবালক এবং নাবালক সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি নগদ অর্থ বা পরিবার পরিচালনার জন্য তেমন কোন আয়ের উৎস রেখে যাননি। এমতাবস্থায় মৃত ব্যক্তির স্ত্রী তথা সাবালক, নাবালক সন্তানদের মা এককভাবে অভিভাবক হয়ে সংসার চালানোর জন্য সরাসরি আদালতের অনুমতি নিয়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি সকলের অংশ থেকে বিক্রি করতে পারেন। অন্যথায় অনেক সময় মা তার নিজের অংশ বিক্রি করে সন্তানদের মানুষ করলেন, পরবর্তীতে মা নিজে নিজের সন্তানদের কাছে বঞ্চিত। আবার, অনেক সময় বড় ভাই বা বোন যদি অভিভাবক না হয়েই নিজের যতটুকু হিস্যা বা অংশ, ততটুকু বিক্রি করে দিয়ে সংসার পরিচালনা করে। পরবর্তীতে ছোট ভাই বোনেরা বড় ভাইকে তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে এবং অতীতের অবদানগুলো বেমালুম ভুলে যায়।

যাই হোক এসব গেলো নীতি কথা। মূল কথা হচ্ছে, আপনি তো ক্রেতা, আপনি কীভাবে নাবালকের সম্পত্তি ক্রয় করবেন?- আপনাকে যদি নাবালকের সম্পত্তি ক্রয় করতেই হয়, তাহলে অবশ্যই আপনি আদালতের অনুমতি আছে কিনা সেটি যাচাই করে নিবেন। যদি আদালতের অনুমতি ব্যতীত, মা বা বাবা এবং সাবালক সন্তানও এসে বলে যে, আমরা রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছি, আমাদের নাবালক সন্তান/ ভাই বোন(সাবালক ভাই বোনদের ক্ষেত্রে) জীবনেও আপনার কাছে আসবে না, মালিকানা দাবি করবে না, আমি অঙ্গীকার দিয়ে যাচ্ছি, তাতে আপনার মন গলে গিয়ে টাকা বের করে যদি দিয়ে থাকেন, তাহলেই আপনি পস্তাবেন; দুই একটা ব্যতিক্রম ব্যতীত এটা মোটামুটি নিশ্চিত।

আপনি পস্তাবেন যেভাবে, আপনি অর্থ পরিশোধ করে যখন জমিতে সুখে শান্তিতে বসবাস করবেন, কয়েক বছর বা হয়ত কয়েক যুগ পরে ঐ যে নাবালকরা যখন সাবালক হবে আর সাথে চালাক চতুর হবে বা আশেপাশে আপনার প্রতিপক্ষ কারো ইন্ধন পাবে, তখন তাদের অংশ বুঝে নিতে তারা মামলা ঠুকে দিবে। কেননা, সাবালক তথা ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে পর্যন্ত কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য যোগ্য হয় না। তার পক্ষে কেউ যদি তার সম্পত্তি বিক্রি করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই আদালতের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ব্যতীত যদি কেউ বিক্রি করে তবে সে অন্যায় করেছে। যে ক্রয় করবে সেও কেন জেনে শুনে বা খোঁজ খবর না নিয়ে ক্রয় করবে?- নাবালক এর জন্য কোনভাবেই দায়ী নয়। সুতরাং, নাবালককে তার জমি বা জমির সমপরিমাণ অর্থ ফেরত দিতে হবে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন, আপনি নাবালকের সম্পত্তি আদালতের অনুমতি ব্যতীত ক্রয় করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবেন কিনা?

[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ পর্ব ১ ।| পর্ব  ২ | পর্ব ৩ ।| পর্ব  ৪ | পর্ব ৫ ।| পর্ব  ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ ]

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.