ভূমি রেকর্ড সংশোধন

জমি রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধনের মামলা

জমি-জমার আইন

একটি জমি দেখতে কেমন, জমি পরিমাণ, জমির শ্রেণী, কৃষি জমি নাকি অকৃষি জমি, ভিটা বাড়ি নাকি নাল জমি, জমির দখলে কে আছে, জমিটির মালিক কে, জমিটি কি যৌথ মালিকানাধীন নাকি একক মালিকানাধীন ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্ন যখন জানতে হয়, তখন সবগুলোর উত্তর একসাথে পাওয়া যায় ওই জমির যে খতিয়ান রয়েছে সেই খতিয়ানে।
একটি জমি সংক্রান্ত এই ধরনের যাবতীয় তথ্যগুলো সরকার জরিপের মাধ্যমে খতিয়ান এবং নকশা প্রস্তুত করে থাকেন। খতিয়ানে সেগুলোকে সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় আর নকশায় চিত্র অংকন করে। ধরুন, একটি জমির মালিক আপনার বাবা এবং চাচারা। এখন ওই জমিটি দেখতে কেমন, জমিটিতে কত শতাংশ জমি রয়েছে, জমিটি কৃষি না অকৃষি ইত্যাদি জমিতে জরিপ করে খতিয়ানে উল্লেখ করা হয়। জরীপ শেষে খতিয়ানে উল্লেখ থাকবে, জমিটির মালিক হচ্ছে আপনার বাবা চাচারা এবং জমিটি কৃষি জমি এতে ৩০ শতাংশ জমি রয়েছে, দখলে আপনার বাবা চাচারা রয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু জমিতে দেখতে কেমন, সেটা কি চতুর্ভুজ নাকি ত্রিভুজ সেটি উল্লেখ থাকবে নকশাতে।
এখন ওই নকশাতে খণ্ড খণ্ড জমির আলাদা আলাদা দাগ নাম্বার দেওয়া থাকবে আর খতিয়ানে ঐ খণ্ড খণ্ড দাগের জমি গুলো মালিক কারা, কতটুকু জমি, জমির শ্রেণি ইত্যাদি উল্লেখ থাকবে। উক্ত খতিয়ানেরও একটি আলাদা নাম্বার থাকবে। এখন কথা হচ্ছে, জরিপ কিভাবে করা হয়ে থাকে?
সরকার সময়ে সময়ে সার্ভেয়ার বা আমীন দিয়ে সরেজমিনে জমি জরীপ বা মাপজোক করে থাকেন। এই মাপজোকের প্রচলন সর্বপ্রথম শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। ১৮৮৮ সালে সর্বপ্রথম সিএস খতিয়ান নামে একটি খতিয়ান প্রস্তুতের কাজ শুরু হয় যা চলেছিল প্রায় ১৯৪০ সাল পর্যন্ত। সিএস খতিয়ানকে এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে সবচেয়ে শুদ্ধ খতিয়ান হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এবং যেহেতু এই খতিয়ানটি প্রথমবারের মত আমাদের অঞ্চলে প্রস্তুত করা হয়, সেক্ষেত্রে তখনকার দিনে সরকারি তথা খাস জমি এবং বেসরকারি তথা মালিকানা জমির যে তথ্য পাওয়া যায় সেটি এখন পর্যন্ত সঠিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
পরবর্তী খতিয়ান গুলোতে যদিও প্রচুর পরিমাণ খাস জমি ব্যক্তি মালিকানায় ঢুঁকে পড়ে। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদার প্রথা যখন উচ্ছেদ বা বাতিল করা হয় তখন এসএ খতিয়ান প্রস্তুত করা হয় যেটি প্রস্তুতে সময় লেগেছে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩, মাত্র ৭ বছর। এত অল্প সময়ের মধ্যে খতিয়ানটি প্রস্তুত করার কারণে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরেজমিনে গিয়ে প্রস্তুত না করার কারণে এসএ খতিয়ানটি সকল খতিয়ানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আর এই ত্রুটি সংশোধন করার জন্য আরএস খতিয়ানের কাজ শুরু হয়, যার মাধ্যমে পূর্বেকার খতিয়ানের ভুলত্রুটি গুলো সংশোধন করা হয়। এরপরে বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে বিএস তথা বাংলাদেশ সার্ভে নামে আরেকটি জরিপ করা হয়, যা কোথাও কোথাও হয়ত এখনো চলছে।
সর্বশেষ খতিয়ান কোথাও বিএস, কোথাও আরএস, কোথাও বা আবার বিআরএস বলা হয়ে থাকে। এর উপর সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সিটি জরিপ নামে সিটি খতিয়ান নামে আরেকটি খতিয়ান রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে সর্বশেষ জরীপ অনুযায়ী প্রস্তুতকৃত খতিয়ানের ভিত্তিতেই জমিজমার ক্রয়-বিক্রয় এবং কর বা খাজনা আদায় করা হয়ে থাকে।
এখন কথা হচ্ছে এই খতিয়ান প্রস্তুত কালে, যদি কোন খতিয়ানে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত কোন ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সেই ত্রুটি সংশোধন করার উপায় কি?
প্রথমত, যখন জরিপ করা হয় আপনাকে আপনার জমিতে উপস্থিত থাকা উচিত। যদি আপনি এলাকার বাহিরে বা দেশের বাহিরে থেকে থাকেন সেক্ষেত্রে আপনার হয়ত উপস্থিত থাকা সম্ভব না কিন্তু চেষ্টা করবেন আপনার পরিবার বা আত্মীয়-স্বজন বা জমিজমার বিষয় বুঝে এমন পরিচিত কাউকে উপস্থিত রেখে জমির শ্রেণী, জমির পরিমাণ, মালিকানা ইত্যাদি সঠিক ভাবে এন্ট্রি হয়েছে কিনা যাচাই করে দেখতে এবং প্রয়োজন জমির পূর্বেকার কাগজপত্র দিয়ে সহায়তা করতে।
জরিপ কাজ শেষে একটি পর্চা দেওয়া হয় জমির মালিকের কাছে, যেখানে খতিয়ানের একটি খসড়া উল্লেখ করা থাকে। আপনি সেটি দেখে যদি সন্তুষ্ট থাকেন সেক্ষেত্রে আর কিছু করার দরকার নেই। আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে সরকারিভাবে গেজেট বের হওয়ার জন্য, যেটি হবে ফাইনাল খতিয়ান।
কিন্তু যদি খতিয়ানে কোন ভুলত্রুটি থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে আপনাকে পর্চা হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই ক্যাম্প অফিসে জানাতে হবে, যদিও সেখানে ৩০ দিনের সময় দেওয়া হয়। প্রজাস্বত্ত্ব বিধিমালা ১৯৫৫ সনের ৩০ বিধি মোতাবেক সরকারী ফি ১০ টাকা দিয়ে আপনার আপত্তি জানাবেন, তখন সেই আপত্তির ভিত্তিতে শুনানি হবে, তারপর সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত।
কিন্তু, কোন কারণে কোন ভুল যদি ঐ সময় আপনার চোখে না পড়ে কিংবা অন্য যে কোন উপায়ে যদি একটি ভুল আপনার খতিয়ানে থেকে থাকে, ক্যাম্প অফিসে সংশোধনের সুযোগ না থাকে এবং সে অনুযায়ী রেকর্ডটি ফাইনাল হয়ে গেজেটেড আকারে বের হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আপনাকে খতিয়ানটি সংশোধন করতে হবে আদালতের মাধ্যমে।
রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধনের জন্য আদালতে মামলা করার নিয়ম
রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধনের জন্য আদালতে মামলা করার নিয়ম হচ্ছে, প্রত্যেক জেলার আদালতে ‘ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল’ নামে একটি ট্রাইবুনাল রয়েছে যেখানে আপনাকে খতিয়ান সংশোধনের মামলা দায়ের করতে হবে। সেখানে আপনার যে ভুলটি হয়েছে, সেটা সংশোধনের জন্য আবেদন করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার জমি যদি ভুলে সরকারের নামে উঠে যায়, সেক্ষেত্রে সরকারকে বিবাদী করে মামলা করতে হবে আর যদি জমি অন্য কোন ব্যক্তির নামে হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তাদেরকে বিবাদী করে খতিয়ান সংশোধন করতে হবে।
সরকার সাধারণত ২০-৩০ বছর পর পর রেকর্ড বা জরীপের কাজ চালিয়ে থাকেন। যতদূর শোনা যাচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটি ডিজিটাল সার্ভে করা হতে পারে যেখানে ড্রোনের সাহায্যে রেকর্ড করা হবে এবং পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকটি জেলার ড্রোন দিয়ে জরিপের কাজ চালানো হয়েছে যাতে ৯৯% এরও বেশি নির্ভুল তথ্য পাওয়া গেছে। তাই সামনে যখনই আপনার এলাকাতে রেকর্ড বা জরিপের কাজ আসবে, তখন চেষ্টা করবেন অবশ্যই এলাকায় থাকতে এবং সঠিক তথ্য দিয়ে নিজের জমির মালিকানা সুনিশ্চিত করতে। ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.