জমির দলিল ও দখলে সমস্যা

দলিলে এবং দখলে গড়মিল – ক্রেতার করণীয়: পর্ব ১

জমি-জমার আইন

জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় এক শ্রেণীর প্রতারক বিক্রেতা আছে যারা একই জমি একাধিকবার বিক্রি করার বন্দোবস্ত করে থাকে। কখনো সফল হয়, কখনো বা জানা শোনা অথবা জমির কাগজপত্র বুঝে এমন কারো হাতে ধরা পড়ে যায়। কিন্তু ততদিনে কারো না কারো সর্বনাশ ঘটিয়ে দেয়। এই শ্রেণীর লোক শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলেও আপনি দেখবেন যারা কিনা একটি জমি কয়েকজন বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে শেষের দিকে কোনো একজনের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে পালিয়ে যায়। একটি জমি গ্রাম অঞ্চলে কয়েক দফা বিক্রি করে টাকা নিয়ে শহরে পালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। সেই ক্ষেত্রে শহর অঞ্চলে একটি জমির মূল্য ৫০ লক্ষ টাকা হলে, দুই বা তিন জনের কাছে বিক্রি করে কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে সেটেল হয়ে যাওয়া এখন রূপকথা নয়। তাই জমি ক্রয়ের সাথে সাথেই জমিতে নিজের নামের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া উচিত। তারও আগে জমিটি কারো কাছে বিক্রি করা হয়েছে কিনা সেটা যাচাই-বাছাই করে নেয়া উচিত। যাইহোক যদিও আজকের আলোচনার বিষয় এটি নয়, তবুও কিছুটা প্রাসঙ্গিক হওয়াতে শুরুতেই একটি পরামর্শ বা উপদেশ দিয়ে শুরু করলাম যাতে পটভূমিটা তৈরি হয়ে যায়।

উপরে যে প্রতারক শ্রেণীর কথা বললাম এই প্রতারক শ্রেণীর ছাড়াও কখনো কখনো ইনোসেন্ট বা ভদ্রলোক থেকে জমি ক্রয় করেও আপনি ক্ষতির শিকার হতে পারেন। আজকের আলোচনা তাদেরকে নিয়ে। একজন ভদ্র বা ইনোসেন্ট বিক্রেতা আপনার কাছে জমি বিক্রি করেছে এবং আপনি জমি ক্রয় করেছেন। এই ক্ষেত্রে আপনাদের উভয়ের অজান্তেই একটা টেকনিক্যাল ভুল হয়ে যেতে পারে যার জন্য আপনি ক্রেতা হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। একটা বিষয় সবসময় মাথায় রাখবেন, জমি ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কখনোই বিক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্রেতা। বিক্রেতা শুধুমাত্র তখনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন যতটুকু জমি বিক্রি করার কথা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ জমি দলিল বিক্রেতার অজান্তে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অন্য কোন ভাবে দলিলের মধ্যে ছোটখাটো ত্রুটি হলে সেটা পুরোটাই গিয়ে বর্তায় ক্রেতার ঘাড়ের উপর। এজন্য ক্রেতা হিসেবে আপনাকে সব সময় সচেতন থাকতে হবে, বিক্রেতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি জানতে হবে আপনাকে। আমাদের ওয়েবসাইট জুড়ে ক্রেতা যাতে জমি ক্রয়ের সময় ত্রুটি না করে, সেই বিষয়ে সবচেয়ে বেশী আলোচনা করা হয়ে থাকে। ক্রেতা ক্রয়ের সময় সচেতন থাকলে নিজে যেমন ঝামেলা এড়াতে পারেন, ঠিক তেমনি জমি নিয়ে ভূমি অফিস থেকে শুরু করে আদালত প্রাঙ্গণের জটও কমাতে পারেন। তাই, Prevention is better than cure. পড়ুন, জানুন, সচেতন হয়ে নিজের অধিকার আদায় করে নিন।

বিক্রেতার জ্ঞাতসারে অর্থাৎ বিক্রেতার জানা মতে অথবা অজান্তেও যদি আপনার সাথে একটি জমি হস্তান্তর করার উদ্দেশ্যে কোন দলিল হয়ে থাকে যে দলিলে জমির পরিমাণ যা উল্লেখ করা হয়েছে সরজমিনে জমির পরিমাণ ঠিক তা না থাকে, সেই ক্ষেত্রে আপনার করনীয় কি? আজকে আমরা সেই সম্বন্ধে একটু বেশী বাস্তবসম্মত আলোচনা করব। ধরুন আপনি একজন বিক্রেতার কাছ থেকে ১০ শতাংশ জমি ক্রয় করলেন, সেই ক্ষেত্রে যদি ধরে নেই যে জমিটি গ্রাম অঞ্চলে এবং শতাংশ প্রতি এক লক্ষ টাকা করে মূল্য, সেক্ষেত্রে আপনার জমির মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১০ লক্ষ টাকা। এখন দলিল রেজিস্ট্রি করার পরে আপনি যখন জমিতে গেলেন বাড়ি করার উদ্দেশ্যে তখন গিয়ে দেখলেন জমিতে ১০ শতাংশ জমি নেই, সেখানে রয়েছে ৯ শতাংশ, তখন বাকি ১ শতাংশ জমি কোন মতেই পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে দেখলেন, ঐ ব্যক্তি আসলে ৯ শতাংশ জমিরই মালিক ছিল বা প্রতিবেশী কার ভেতরে ১ শতাংশ ঢুঁকে গেছে। এখন আপনি তো আর টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করে প্রতিবেশীর সাথে বিরোধ সৃষ্টির দরকার নেই। তাহলে,এই ১ শতাংশ জমির জন্য আপনি কি করবেন? ঝগড়া, মারামারি, কাটাকাটি করা তো আপনার মত ভদ্রলোক দ্বারা সম্ভব নয়। তাই, প্রথমে আপোষের মাধ্যমে মীমাংসা করার চেষ্টা করবেন, কিন্তু তাতে ব্যর্থ হলে তখন বাধ্য হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। 



সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১৪ ধারায়, একটি চুক্তির অংশবিশেষ সুনির্দিষ্টভাবে সম্পাদন, যেখানে অসম্পাদিত অংশ ছোট; এই সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। যেহেতু স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর এক ধরনের চুক্তি এবং আপনাদের মধ্যকার হস্তান্তরিত চুক্তিটির বড় অংশই সম্পাদিত হয়েছে অর্থাৎ ১০ শতাংশ জমির মধ্যে ৯ শতাংশ জমি আপনাকে সরজমিনে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছোট অংশটি অর্থাৎ এক শতাংশ জমি আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারেনি, সে ক্ষেত্রে ১ শতাংশ জমির হিসাব বুঝে না পাওয়াতে আপনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। যদিও এখানে আমি শুধুমাত্র আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এই দিকটি তুলে ধরছি, কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় যে ১ শতাংশ জমির জন্যই পুরো সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায় বা সন্তানদের মাঝে সুষম বণ্টন সম্ভব হয় না বা যে পরিকল্পনা অনুসারে উক্ত জমিতে বাড়ি করার চিন্তাভাবনা করেছেন এক শতাংশ জমি কম হওয়ার কারণে আপনার উক্ত পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই বিক্রেতাকে আপনি সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করে চেষ্টা করবেন আপনার বাকি ১ শতাংশ জায়গা দখল পুনরুদ্ধার করে দিতে। দখল বুঝিয়ে দিতে গিয়ে যদি বিক্রেতা সেই জমির মধ্যে নিজের মালিকানা থেকে থাকে বা অন্যের কাছ থেকে উদ্ধার করে আনতে পারেন, তাহলে আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন; তখন চুক্তি অনুযায়ী সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু যদি বিক্রেতার নিজেই ওই জমির মালিকানা না থাকে বা অন্যের কাছ থেকে উদ্ধার করতে না পারেন অর্থাৎ তিনি বৈধভাবে ৯ শতাংশ জমির মালিক মাত্র অথবা জরিপের টেকনিক্যাল কারণে এক শতাংশ কম জমি রয়েছে(এই ত্রুটি নিয়ে বিস্তারিত লিখবো কখনো সময় পেলে), সে ক্ষেত্রে বিক্রেতার কিছু করার না থাকলে, কিভাবে এই চুক্তিটি সম্পাদন করা যায় তার সমাধান সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১৪ ধারাতে বলা হয়েছে। যেহেতু চুক্তির বড় অংশটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে সে ক্ষেত্রে বাকি অংশটুকু অর্থাৎ ছোট অংশটুকুটি যা আমাদের উদাহরণ মতে ১ শতাংশ, এই ১ শতাংশ জমি কম পাওয়ার ফলে চুক্তির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নের জন্য আদালতে মামলা করলে আদালত, যেহেতু বিক্রেতা ১ শতাংশ জমি আপনাকে হস্তান্তর করতে পারেনি তার জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন অথবা ১ শতাংশ জমির যে ক্রয় মূল্য ছিল তা আপনাকে ফেরত দিতে পারে। অর্থাৎ, আপনি শুধুমাত্র ১ লক্ষ টাকা পেতে পারেন ১ শতাংশ জমির ক্রয় মূল্য হিসেবে(যেহেতু উদাহরণ হিসেবে জমির ক্রয় মূল্য ১ লক্ষ টাকা ধরা হয়েছিল) আবার আদালত চাইলে বিক্রেতাকে ক্ষতিপূরণ প্রদানেরও নির্দেশ দিতে পারেন। আশা করি, বুঝতে সক্ষম হয়েছেন।

আগামী পর্বে আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করব একই ধরনের আরেকটি ঘটনা নিয়ে, যেখানে একজন বিক্রেতার কাছ থেকে আপনি ক্রেতা হিসেবে জমি ক্রয় করার পরে সরজমিনে গিয়ে দেখলেন যতোটুকু জমি বিক্রি করেছে সেই জমির অর্ধেক বা তারও কম সরজমিনে রয়েছে; অর্থাৎ বেশিরভাগ জমির দখল নেই। সেই সম্বন্ধে আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করার চেষ্টা করব, আজকে এই পর্যন্তই।

[ পরের পর্ব – ০২ ]

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.