জমি রেকর্ড সংশোধন

জমির দলিল একজনের নামে কিন্তু রেকর্ড আরেকজনের নামে হলে ক্রেতার জমি কেনা উচিত কি?

জমি-জমার আইন দেওয়ানি আইন

একটি জমি কেনার আগে যদি ক্রেতা জানতে পারে যে, ঐ জমির দলিল সূত্রে মালিক হচ্ছে একজন, আর রেকর্ড সূত্রে মালিক হচ্ছে আরেকজন। সেই ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ক্রেতার কি উচিত হবে উক্ত জমি ক্রয় করা?- আজকের আর্টিকেল জুড়ে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।
প্রথমে জেনে নেই, একটি জমির দুইটি ভিন্ন সূত্রে দুই জন বৈধ মালিক কীভাবে থাকে। একটি জমির একই সময়ে একাধিক মালিক থাকতে পারে, যদি উক্ত জমির জাল দলিল থেকে থাকে। কিন্তু, জাল দলিলের মাধ্যমে যে মালিকানা দাবি করা হয় সেটা সম্পূর্ণ আইনত অবৈধ। এখানে জেনে রাখা ভালো, একটি জমি যদি একই বিক্রেতা কর্তৃক একাধিক বার বিক্রয় করা হয়, তাহলে প্রথম যে দলিলটি সম্পাদিত এবং রেজিস্ট্রিকৃত হবে, সেটি ব্যতীত বাকী সকল দলিল জাল দলিল হিসেবে চিহ্নিত হবে। তাহলে এখানে স্পষ্ট যে, দলিল সূত্রে একই সময়ে কেবলমাত্র একজন বৈধ মালিক থাকতে পারে। তাহলে এখন প্রশ্ন, একটি জমির দুই জন বৈধ মালিক কীভাবে থাকে?
দলিল সূত্রে যেমন জমির মালিক হওয়া যায়, রেকর্ড সূত্রেও জমির মালিক হওয়া যায়। আমরা যে, সিএস, আরএস, বিএস ইত্যাদি রেকর্ডের নাম শুনে থাকি, সেইসব রেকর্ডের মাধ্যমেও জমির মালিক হওয়া যায়। আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম রেকর্ড করা হয়, সিএস রেকর্ড। তখন যাকে যে জমির দখলে পেয়েছে, তাকে সেই জমির দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তখন জমির দখল সত্ত্বের উপর ভিত্তি করে রেকর্ড করায় সিংহভাগ মানুষই রেকর্ড সূত্রে বা খতিয়ান সূত্রে জমির মালিক হয়েছে। তারপর আসলো আরএস রেকর্ড, এরপর বিএস। পরবর্তী রেকর্ডগুলোর সময় জমির দখল সত্ত্বের পাশাপাশি দলিল দস্তাবেজও দেখেছেন সার্ভেয়াররা। তখন, জমির মালিকদেরকে নিজ নিজ নামে খতিয়ান বা কয়েকজনকে একটি খতিয়ানে জমির পরিমাণ, হিস্যা উল্লেখ করে মালিক ঘোষণা করা হয়েছে। এই রেকর্ডের ভিত্তিতেও একজন ব্যক্তি একটি জমির বৈধ মালিক হতে পারেন।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ব্যক্তি যদি একটি জমির দলিল সূত্রে এবং রেকর্ড সূত্রে মালিক হয়, তাহলে তো কোন সমস্যা নেই; কিন্তু যদি একই জমির একজন মালিক দলিল সূত্রে হয় আর আরেকজন রেকর্ড সূত্রে মালিক হয়, তাহলে জমির প্রকৃত মালিক কে? -এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া গেলেও সেটা বিশাল জটিলতা তৈরি করবে এবং পরিস্থিতি ভেদে উত্তরটি ভুল হয়ে সম্পূর্ণ পাল্টেও যেতে পারে। তাই, সিএস রেকর্ডের মতো খণ্ড খণ্ড করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়াই ভালো; বুঝতে সহজ হবে।
জমির মালিকানা নির্ধারণ করতেই মূলত সরকার নিজ উদ্যোগে নিজ খরচে রেকর্ড করিয়ে থাকে। সরকারি ভাবে যেহেতু এই রেকর্ড কার্য হয়ে থাকে, সেহেতু সরকারি হিসেবে জমির মালিক হচ্ছেন যার নামে জমিটি রেকর্ড করানো আছে। এখন কোন রেকর্ড সূত্রে মালিক যদি তার মালিকানাধীন জমি অন্য কারো কাছে বিক্রি করতে হয়, তখন তাকে সাব- রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রি করতে হয় যাতে বিক্রেতা ক্রেতার নিকট জমি হস্তান্তর করে এই বাবদ লিখিত দলিল সম্পাদন করছে এটা পরবর্তীতে অস্বীকার করতে না পারে। তারপর ক্রেতার দায়িত্ব হচ্ছে, সরকারি খাতায় তথা ভূমি অফিসে যেহেতু পূর্বের মালিকের নাম এখনো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তার নাম বাতিল বা খারিজ করিয়ে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করা, যাকে বলে নামজারি। এই যে প্রক্রিয়াটি, এটি নিয়ে সময়ের কোন তামাদি নেই বলে অনেকেই জমি ক্রয় করার পরও জমি নামজারি করায় না, তথা রেকর্ডে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করে না তথা নিজ নামে খতিয়ান প্রস্তুত করে না বিধায় এই জটিলতা গুলো তৈরি হয়।
ধরুন, ‘ক’ জমির বিক্রেতা, ‘খ’ জমির ক্রেতা। ‘ক’ দলিল এবং রেকর্ড সূত্রে একটি জমির মালিক। ‘ক’ তার জমিটি বিক্রয় করার ইচ্ছা পোষণ করায় ‘খ’ উক্ত জমি কিন্তু আগ্রহ প্রকাশ করে। তথাপি, ‘খ’ সাব- রেজিস্ট্রি অফিস গিয়ে ‘ক’ এর কাছ থেকে দলিল রেজিস্ট্রির মাধ্যমে উক্ত জমির মালিকানা পেয়ে যায়। এরপর ‘খ’ এর আর কোন খবর নাই, অর্থাৎ নামজারি/ খারিজ করায়নি। এভাবে কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর ‘খ’ যেকোনো প্রয়োজনে ঐ জমিটি আবার বিক্রি করার ইচ্ছে পোষণ করল। এমতাবস্থায় আপনি ঐ জমি ক্রয় করতে গেলেন এবং জমির দলিল এবং রেকর্ড সমূহ তল্লাশি দিয়ে দেখলেন যে, জমির মালিক তো দুইজন। দলিল সূত্রে ‘খ’ আর রেকর্ড সূত্রে ‘ক’। এমতাবস্থায়, আপনি কি জমিটি ক্রয় করবেন?
কাগজে কোন ঝামেলা থাকলে জমি কিনবেন না, এটা হচ্ছে ফরয। কিন্তু, কখনো কখনো এমন কিছু জমি থাকে যেগুলো একেবারে আপনার জন্য জরুরী। যেমন, আপনার পাশের জমিটি, আপনি চাইবেন বাহির থেকে কেউ একজন এসে ঐ জমিটি কিনে নিক এবং ভবিষ্যতে আপনার সাথে সীমানা নিয়ে ঠেলাঠেলি করুক। আবার, একটা জমি ভবিষ্যতে খুব মূল্য হবে বা আপনার ওয়ারিশ বেশি, তাদের জন্য জমির প্রয়োজন, তখন কিন্তু আমরা ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও জমি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করি। অন্যান্য ঝামেলাযুক্ত জমি অতীব প্রয়োজনে কীভাবে কি সচেতনতা মেনে ক্রয় করা যায়, সে বিষয়ে অন্য একদিন আলাপ করবো; আজ শুধু এই জটিলতা নিয়ে আলাপ করবো।
দলিল সূত্রে ‘খ’ আর রেকর্ড সূত্রে ‘ক’, এমতাবস্থায় যেহেতু ‘খ’ ক্রয় করেছে ‘ক’ এর কাছ থেকে সেহেতু আপনি ‘খ’ কে বলুন, আগে সে নিজের নামে জমিটি খারিজ/ নামজারি করিয়ে নিতে। তাহলে ‘খ’ দলিল এবং রেকর্ড উভয় সূত্রেই মালিক হয়ে যাবে। তখন আপনি কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই জমিটি ক্রয় করতে পারবেন। কিন্তু, কখনো কখনো সময় স্বল্পতার কারণে যদি ‘খ’ নিজ নামে খারিজ করাতে না পারে বা ভূমি অফিসেও আলাপ করে ভায়া দলিল দেখিয়ে খারিজ/ নামজারির আবেদন করতে পারেন, তবে সেটা খারিজ/ নামজারি হবে কিনা তা অনিশ্চিত। তাই, কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে তারপরই কেবল জমি ক্রয় বা বায়না করা উচিত।

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.