বায়না দলিল

বায়না দলিল বাতিল ও প্রবলের মামলা

জমি-জমার আইন

একটি জমি বা ফ্ল্যাট বা যেকোনো ধরনের স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় বিক্রয়ের জন্য বায়না দলিল করা হলে সেই দলিল যে অবশ্যই হস্তান্তর দলিলে পরিণত হবে তা কিন্তু নয়। কখনো এক পক্ষের ইচ্ছায় আবার কখনো বা উভয় পক্ষের সম্মতিতে একটি বায়না দলিল বাতিল হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, এক পক্ষ চাইলেই যে বায়না দলিল বাতিল করে অপরপক্ষের ক্ষতিসাধন করবে তাও কিন্তু নয়। কেননা, অপরপক্ষ চাইলে বায়না দলিল বলবত করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। চলুন জেনে নেই, কিভাবে একটি বায়না দলিল বাতিল করা যাবে এবং একপক্ষ বাতিল করতে ইচ্ছুক বায়না দলিলকে প্রবল করা যাবে।

বায়না দলিল রেজিস্ট্রেশন করা থাকলে, বায়না মেয়াদকালের (পড়ুন: বায়না দলিল কি, কেন, কিভাবে) মধ্যে যদি উভয় পক্ষ যেকোনো কারণে সম্মত হয় যে, তারা বায়না দলিল বাতিল করবে, তাহলে তাদের পূর্বের সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়েই বায়নানামা বাতিল বা রহিতকরণ দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। অর্থাৎ, যে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে বায়না দলিল রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল, সেই সাব রেজিস্ট্রি অফিসেই উক্ত রহিতকরণ দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। উল্লেখ্য, স্থাবর সম্পত্তি যে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের আওতাধীন, সেই সাব রেজিস্ট্রি অফিসেই সকল দলিল দস্তাবেজ রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।

উভয় পক্ষের সম্মতি ব্যতীত বায়নার মেয়াদ থাকাকালীন সময়ে বায়না দলিল বাতিলের মামলা করা যাবে না। অর্থাৎ, বায়না দলিলের মেয়াদ যদি ৬ মাস হয়, উক্ত ৬ মাসের মধ্যে বায়না দলিল বাতিলের মামলা করা যাবে না। তবে, উভয়ের সম্মতিতে যেকোনো সময়ই উক্ত বায়না দলিল বাতিল করা যাবে। বায়না দলিল সবচেয়ে বেশী যে দুইটি কন্ডিশনে জটিলতা বা আইনানুগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়, সেগুলো নিয়েই নিম্নে আলোচনা করা হল।

ক্রেতা অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে বিক্রেতার করণীয়

বায়না চুক্তিতে যে ব্যাপারটি সবচেয়ে কমন এবং সচরাচর ঘটে থাকে তা হচ্ছে, আবেগের বশবর্তী হয়ে বা পুরো টাকার বন্দোবস্ত না করে আংশিক টাকা দিয়ে বায়না করার পরে ক্রেতা যখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করতে পারেনা তখন বিক্রেতা দিশা খুঁজে পান না কি করবেন। কারণ সাধারণত আমি-আপনি যারা সম্পত্তি, স্থাবর-অস্থাবর যেকোনো সম্পত্তি বিক্রি করার ইচ্ছা পোষণ করি, সেটা কখনোই খুশিতে, ঠেলায় বা ঘুরতে বিক্রি করতে চাই না। সকলেই একটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনে বা জরুরী কার্যসিদ্ধ যেমন আর্থিক সংকট, চিকিৎসা, ব্যবসার মূলধন, বিদেশ গমন, পাওনা টাকা পরিশোধ ইত্যাদি উদ্দেশ্যেই আমরা আমাদের প্রিয় সম্পত্তিটির মায়া ত্যাগ করে বিক্রি করতে ইচ্ছা পোষণ করি এবং সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সময়ের একটি বিধিনিষেধ রয়েছে। এখন যদি কোনো ক্রেতা আমাদেরকে আংশিক কিছু টাকা দেওয়ার পরে প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করতে না পারে, তাহলে আমরা আমাদের যেই কার্য সিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে উক্ত জমি বিক্রি করার জন্য বায়না করেছে সেই সম্পদটির বিনিময়ে কাঙ্ক্ষিত অর্থ না পেয়ে থাকি, সেই ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি?



করণীয়: পূর্বেই বলেছি, বায়নার মেয়াদ থাকাকালীন সময়ে বায়না দলিল বাতিলের মামলা করা যাবে না। অর্থাৎ, বায়না দলিলের মেয়াদ যদি ৬ মাস হয়, উক্ত ৬ মাসের মধ্যে বায়না দলিল বাতিলের মামলা করা যাবে না। অতএব, বিক্রেতা হিসেবে আমাদেরকে প্রথমে বায়না দলিলে উল্লেখিত সময় শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় দিতে হবে। উক্ত সময়ের পরেও যদি ক্রেতা কিছু সময় চায় তাহলে মানবতার খাতিরে আমরা সেই সময় দিতে পারি তবে সেটি অবশ্যই লিখিত হতে হবে; তবে সেটি কোন মতেই দীর্ঘ সময় হতে পারবে না। কেননা, বায়না দলিলে উল্লেখিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরবর্তী ১ বছরের মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী চুক্তি তথা বায়না দলিল বাতিলের মামলা করতে হবে। মামলায় বায়না দলিল বাতিলের পাশাপাশি বায়নার পরিশোধিত টাকাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবী করা যেতে পারে, যদি দাবী গ্রহণ বর্জন সব কিছুই আদালতের এখতিয়ার। তবে, আদালত উক্ত বায়না চুক্তি তথা দলিল বাতিল ঘোষণা করলে তখন আমরা বিক্রেতারা যেখানে খুশী সেখানে আমাদের জমিটি বিক্রি করতে পারবো; আইনানুগ আর কোন বাঁধা থাকছে না।

বিক্রেতা পল্টি মারলে, ক্রেতা হিসেবে আমাদের করণীয়

আমি বা আপনি ক্রেতা হিসেবে যখন কোনো বিক্রেতার কাছ থেকে একটি সম্পত্তি ক্রয় করার জন্য বায়না পত্র করে থাকি এবং কিছু আংশিক টাকা পরিশোধ করে থাকি, সেই ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সময়ের মধ্যে আমরা যখন বাকি টাকা পরিশোধ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছি সেই সময় বিক্রেতা যদি উক্ত সম্পত্তি আমাদের কাছে বিক্রি করতে না চায়, সেটি যেকোনো কারণে হতে পারে, বিক্রেতা উক্ত সম্পত্তি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন আবার আমাদের থেকেও ভালো মূল্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কাছে বিক্রি করার ইচ্ছাও পোষণ করতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে ক্রেতা হিসেবে আমাদের করণীয় কি?

করণীয়: প্রাচীন প্রবাদকে কিছুটা আধুনিক করে এখন বলা হয়, লোভে পাপ, পাপে পলটি। বিক্রেতারা হরহামেশায়ই এমন পলটি মারে। শতাংশ বা কাঠা প্রতি ৫-১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিবে শুনলেই বিক্রেতারা বায়নাপত্র অস্বীকার করে বায়নার ক্রেতাকে ঠকাতে চায়। তখন ক্রেতা হিসেবে আমাদেরকে দলিলে উল্লেখিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দলিলে কোন সময় উল্লেখ না থাকলে বায়না দলিল রেজিস্ট্রেশনের দিন থেকে ৬ মাস অপেক্ষা করতে হবে। তারপরেও যদি বিক্রেতা অর্থ নিয়ে দলিল রেজিস্ট্রেশন করে দিতে না চায়, তখন ক্রেতা হিসেবে আমাদেরকে বায়না চুক্তি বা বায়না দলিল প্রবলের মামলা করতে হবে। মামলা করতে হবে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এর ১২ ধারার অধীনে এবং অবশ্যই বায়না দলিলে উল্লেখিত মেয়াদ শেষ হওয়ার ১ বছরের মধ্যে। আদালত সন্তুষ্ট হলে বাকি টাকা পরিশোধের মাধ্যমে উক্ত চুক্তি বা বায়না দলিল কার্যকর করে মূল দলিল সম্পন্ন করাতে পারেন।

এখানে উল্লেখ্য, অনেক সময় বিক্রেতা বায়না দলিল করার পর মৃত্যুবরণ করেন, তখন ক্রেতা হিসেবে আমাদের করণীয় কি? এই ক্ষেত্রে আমরা বিক্রেতার ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকার যারা রয়েছে, যারা বিক্রেতার মৃত্যুতে উক্ত সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন, তাদেরকে বায়না দলিলের বিষয়টি জানিয়ে মূল দলিল রেজিস্ট্রেশনের কথা বলবো। উত্তরাধিকাররা যদি বায়নার বাকি টাকা গ্রহণ করে মূল দলিল রেজিস্ট্রেশন করে দেয় তাহলে আর কোন ঝামেলা থাকল না। কিন্তু উত্তরাধিকাররা যদি মূল দলিল রেজিস্ট্রেশন করে দিতে অস্বীকার করে, সে ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী চুক্তি প্রবলের তথা বায়না দলিল প্রবলের মামলা করতে হবে। তবে বলাবাহুল্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী চুক্তি প্রবলের তথা বায়না দলিল প্রবলের মামলার শর্ত হচ্ছে যে, বায়না দলিলটি অবশ্যই রেজিস্ট্রিকৃত হতে হবে এবং বায়না দলিলের অবশিষ্ট টাকা আদালতে জমা দিতে হবে।
এই জটিলতা গুলোই সচরাচর ঘটে থাকে, আশা করি বুঝাতে কিছুটা হলেও সক্ষম হয়েছি। তারপরও আপনার জানা কোন জটিলতা থেকে থাকলে আমাদেরকে জানাবেন, আমরা গবেষণার নিমিত্তে সমাধানের উপায় সম্বন্ধে লেখার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্‌।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.