জমির দাগ বণ্টন

সম্পত্তি দাগে দাগে নিবেন নাকি এক দাগে

জমি-জমার আইন

সলিমুল্লাহ খান সাহেবের শহরে এবং গ্রামের বাড়িতে একাধিক সম্পত্তি রয়েছে। শহরে ওনার নিজ নামে একটি বাড়ি রয়েছে এবং গ্রামেও কৃষি-অকৃষি বিভিন্ন জমি রয়েছে। উক্ত জমিগুলোর মধ্যে কিছু জমির মূল্য বেশি এবং কিছু জমির মূল্য অপেক্ষাকৃত কম। স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায় যে, জমির শ্রেণী পরিবর্তন হলে জমির মূল্য পরিবর্তন হয়। তাছাড়া শহরে এবং গ্রামের জমির মূল্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকে।

এখন সলিমুল্লাহ খান সাহেবের মৃত্যুর পর ওনার সন্তানদের মধ্যে উক্ত সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে ঝামেলা লেগে গেছে। প্রত্যেকেই শহরের মূল্যবান যে বাড়িটি রয়েছে সেই বাড়িটির মালিকানা দাবি করে বা অংশ চায়; সে অনুযায়ী গ্রামের সম্পত্তি কেউই চায় না। এখন আমরা জানি যে একটি সম্পত্তি যখন বণ্টন করা হবে তখন ঐ সম্পত্তির পরিমাণ যা রয়েছে, তা সকল ওয়ারিশদের মধ্যে তাদের অংশ বা হিস্যা অনুযায়ী সমহারে বণ্টন করা হয়।

ধরুন, আমাদের কল্পিত গল্পের সলিমুল্লাহ খান সাহেবের ১০০ শতাংশ জমি রয়েছে আর তার ৫ ছেলে রয়েছে। এখন প্রত্যেক ছেলে ২০ শতাংশ হারে সম্পত্তি পেয়ে থাকবে যদি স্ত্রী এবং কন্যা না থেকে থাকে। ধরে নিলাম সলিমুল্লাহ খান সাহেবের স্ত্রী এবং কন্যা নেই, শুধুমাত্র ৫টি ছেলে রয়েছে এবং সলিমুল্লাহ খান সাহেবের ১০০ শতাংশ জমির মধ্যে শহরে ১০ শতাংশ এবং ৯০ শতাংশ হচ্ছে গ্রামে।
এখন সবাই বিভিন্ন যুক্তিতে গ্রামের সম্পত্তি নিতে চায় না; প্রত্যেকেরই যুক্তি হচ্ছে সে ঢাকা শহরে থাকবে। গ্রামের সম্পত্তির দরকার নেই; তাই কেউই গ্রামের সম্পত্তি নিবে না। চাকরী বা ব্যবসা বা সন্তানদের পড়াশোনার কারণ দেখিয়ে সবাই ঢাকার সম্পত্তি চায়, গ্রামেরটা চায় না। কারণ, আজকাল ঈদ ছাড়া গ্রামে যাওয়া হয় না আর গ্রামের সম্পত্তিতে আয় রোজকারও নেই।

এমতাবস্থায় হিসাব করে দেখা গেছে যে, শহরের ১০ শতাংশ জমির যে মূল্য রয়েছে তা গ্রামের ৯০ শতাংশ জমির চাইতেও অনেক গুণ বেশি। তাই, কয়েক দফা ঘরোয়া বৈঠক করার পরেও যখন সমঝোতা করা সম্ভব হয়নি তখন সলিমুল্লাহ খান সাহেবের সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে এই বলে আপোষ করে যে, তাহলে সম্পত্তি প্রতি দাগে দাগে
ভাগ করা হবে।

প্রত্যেককেই প্রত্যেক দাগে তার হিস্যা অনুযায়ী সম্পত্তি নিতে হবে অর্থাৎ ঢাকা শহরে ১০ শতাংশ জমির উপর যে বাড়ি রয়েছে, সেটি যেমন ৫ জন মালিক হবে আবার গ্রামে যে ৯০ শতাংশ জমি আছে বিভিন্ন দাগে, সেখানেও প্রত্যেকে প্রত্যেক দাগে দাগে সম্পত্তি নিতে হবে। যদি আদালতের মাধ্যমে বণ্টন মামলা করা হতো সেক্ষেত্রেও হয়তো এই ধরনের বণ্টন করা হতো। প্রত্যেকের প্রত্যেক দাগে সম্পত্তি দেওয়া হবে, কাউকে নির্দিষ্ট একটি দাগে সম্পত্তি দেওয়া হবে না।

এখন প্রতি দাগে দাগে সম্পত্তি নেওয়া ভালো নাকি একেকজন একেক দাগে সম্পত্তি নেওয়া ভালো, এই বিষয় নিয়ে আজকে আমরা আলোচনা করব।
আশা করি এতোটুকু বুঝতে পারছেন যে, যদি আপনি উপরের ঘটনা অনুযায়ী গ্রামের দাগ থেকে সম্পত্তি নিয়ে থাকেন সেই ক্ষেত্রে আপনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, কারণ আপনার গ্রামের জমির মূল্য কম। অন্যদিকে আপনি যদি একচেটিয়া ভাবে শহরের দাগের সম্পত্তি নিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনি আর্থিকভাবে লাভবান হবেন, কারণ শহরে জমির মূল্য বেশি।
এখন কথা হচ্ছে প্রত্যেকের তো আর গ্রাম এবং শহর উভয় জায়গায় জমি থাকে না, যেক্ষেত্রে পুরো জমিটাই হচ্ছে গ্রামে বা শহরে সেই ক্ষেত্রে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে কি করবেন?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্পত্তি যখন গ্রামে থাকে, তখন একাধিক দাগে সম্পত্তি থাকে। এখন প্রত্যেক ভাই বোন বা অংশীদারকে যদি প্রত্যেক দাগে দাগে সম্পত্তি দেওয়া হয় তখন সেই সম্পত্তির যথার্থ ব্যবহার করা সম্ভব হয় না; যদিও শহরে ব্যতিক্রম।
কারণ শহরে আপনি যদি ৫ শতাংশ জমির উপর একটি বাড়ি করে থাকেন, সেক্ষেত্রে ঐ বাড়িতে সকল অংশীদারকে মালিক করলে সমস্যা নেই। কারণ শহরে ছোট জায়গার উপর বহুতল বিশিষ্ট বিল্ডিং করা হয়, যাতে অনেকগুলো ফ্ল্যাট থাকে। তখন প্রত্যেক অংশীদার হয়তো এক বা একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারে কিংবা নিজে ভোগ দখল করতে না পারলেও এক বা একাধিক ফ্ল্যাট বা একটি ফ্ল্যাটের একটি ছোট অংশের ভাড়া সে আদায় করতে পারে।

কিন্তু গ্রামে যদি একটি দাগে ১০ শতাংশের একটি জমি থাকে এবং সেখানে যদি একাধিক মালিক থাকে সেক্ষেত্রে সেই জমিটিতে কোন ধরনের চাষাবাদ বা উন্নয়ন করা সম্ভব হয় না। কারণ ৫ জন মিলে যদি একটি দাগের মালিক হয় সেক্ষেত্রে কৃষি কাজ করার জন্য ৫ জনকে একমত করা যায় না, পুকুর হলে ঐখানে মাছ চাষ করার জন্য একমত করা যায় না। তাই, গ্রামে একেকজনকে একেক দাগে সম্পত্তি দেওয়া তুলনামূলক ভালো।

যদিও নিজেদের মধ্যে আপোষ বণ্টন করা সম্ভব না হলে আইনত প্রত্যেককেই প্রত্যেক দাগে মালিকানা দেয়া হয়ে থাকে, কিন্তু মাথায় রাখতে হবে প্রত্যেকে যদি প্রত্যেক দাগে দাগে মালিকানা অর্জন করে, সেক্ষেত্রে সেটি সবসময় শুভকর নাও হতে পারে। বিশেষ করে, গ্রামের কৃষি সম্পদ গুলোর মধ্যে একের অধিক মালিক থাকলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার অভাবে কোন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ বা কৃষি চাষ করা হয়ে থাকে না।

শহরের ক্ষেত্রে অবশ্যই সমস্যাটা হয় না তেমন, কারণ শহরে ছোট জায়গার মধ্যে বহুতল বিশিষ্ট আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক বিল্ডিং স্থাপন করে উপার্জনের পথ করা যেতে পারে; সেটার থেকে উপার্জনের অংশ সবার মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে।
বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত হচ্ছে, গ্রামে বোন বা ফুফুদেরকে এক দাগে সম্পত্তি দিতে গিয়ে সবচেয়ে কম দামী সম্পত্তিগুলো দেওয়া হয়ে থাকে বা বাণিজ্যিক জমিতে ভাগ দেওয়া হয় না, তাই তখন আবার দাগে দাগে সম্পত্তি বণ্টনটি উপকারে আসে।

তাই, ঢালাও ভাবে বলা যাবে না যে, দাগে দাগে সম্পত্তি বণ্টন ভালো নাকি একেক জনকে একেক দাগে সম্পত্তি দেওয়া ভালো। এটি অবস্থাভেদে, জমি ভেদে, পরিবার ভেদে একেক জায়গায় একেকটি ভালো হবে। তবে ভাই বোন বা চাচা মামার সাথে সম্পর্ক খারাপ না করে ঘরোয়া ভাবে আপোষ বণ্টন করাই উত্তম। আশা করি, বুঝতে পেরেছেন, ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.