সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন

সম্পত্তি হতে দখলচ্যুত হলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার

জমি-জমার আইন

আমাদের সম্পত্তি দুই প্রকার অস্থাবর এবং স্থাবর। অস্থাবর সম্পত্তি হচ্ছে যেগুলোকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যায়। অন্যদিকে স্থাবর সম্পত্তি হচ্ছে, জমি বা জমির সাথে এডজাস্ট যেমন জমির উপর স্থাপিত বাড়ি, গাছ ইত্যাদি যেগুলোকে স্বাভাবিক ভাবে স্থানান্তর করা যায় না। আজকে আমরা নিজেদের স্থাবর সম্পত্তি হতে বেদখল বা দখলচ্যুত বা উচ্ছেদ হলে করণীয় কি সেই বিষয়ে আলোচনা করবো।

পেশাগত কারণে বা অন্য যেকোনো কারণে আমরা যখন আমাদের জমি হতে দূরবর্তী কোনো স্থানে বসবাস করি, তখন আমাদের ওই জমিটি স্থানীয় কোন অসাধু শক্তিধর ব্যক্তির মাধ্যমে বেদখল হয়ে যেতে পারে; আবার সবসময় জমি থেকে দূরবর্তী স্থানে বসবাসের কারণে যে বেদখল হবে তা কিন্তু নয় কখনো কখনো নিজের জমিতে থাকা অবস্থাতেও আমাদেরকে বেদখল করা হতে পারে। অসাধু শক্তিধর বললাম এই অর্থেই যে, বেশীরভাগ জোর করে দখল করা লোকরাই অসাধু এবং শক্তিধরই হয়ে থাকে। তাদের পেশীর জোর থাকে, লাঠিয়াল বাহিনী থাকে, অর্থের যোগান থাকে আর কথিত উপরের লেভেলের লোক থাকে। এখন এই ধরনের কোন অসাধু শক্তিধর ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দ্বারা আপনি যখন আপনার নিজের জমি থেকে বেদখল বা দখলচ্যুত বা উচ্ছেদ হয়ে যাবেন, তখন আপনাকে কি করবে হবে সেটিই আজকের আলোচ্য বিষয়।
অতীতে আমরা অনেক জায়গায় দেখেছি যে, সম্পত্তি থেকে বেদখল হলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। যে পক্ষ সম্পত্তি দখলে নিয়েছে তারাও লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে অন্যায়ভাবে দখল বজায় রাখার চেষ্টা করে আবার যাদের জমি বেদখল হয়েছে তারাও পরবর্তীতে নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দখল পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় যখন আইনের শাসন বাস্তবায়ন হতে শুরু করল, তখন কিছু মানুষ পেশী শক্তির প্রদর্শন থেকে বেরিয়ে এসে আইনের আশ্রয় নিতে শুরু করলো।

এখন কথা হচ্ছে আইনের আশ্রয় নিয়ে কি সকলেই জমির দখল পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে? উত্তর হবে ‘না’। তার জন্য কি আইন কে দোষারোপ করা যাবে? সেক্ষেত্রেও বলা হবে ‘না’। তাহলে কি পুলিশ প্রশাসন বা স্থানীয় সরকারকে দোষারোপ করা যাবে? আমি এক্ষেত্রেও বলবো ‘না’। তাহলে কি কারণে আইনের আশ্রয় নেওয়া সত্ত্বেও আমরা আমাদের বৈধ মালিকানাধীন সম্পত্তি থেকে বেদখল হওয়ার পরেও দখল পুনরুদ্ধার করতে পারছি না, এখন আসুন একেবারে শুরু থেকে শুরু করা যাক।



আপনি জমিতে থাকেন অথবা জমি থেকে দূরে কোথাও থাকেন আপনার জমি বেদখল হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা অনুসারে, দখল পুনরুদ্ধারের মামলা করতে হবে। দেখুন, সেই ১৮৭৭ সাল থেকে এই আইনটি আমাদের ভারতবর্ষে প্রচলিত রয়েছে আর তারই পরম্পরায় এখন আমাদের দেশে বলবৎ রয়েছে। সম্পত্তি সংক্রান্ত বিশেষ করে স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে এই আইনটি হচ্ছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বগত আইন। অথচ আমাদের দেশে স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের প্রয়োগ না করে আমরা লাফ দিয়ে চলে যাই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪/১৪৫ ধারার অধীনে। কিন্তু আপনাকে যদি সত্যিকার অর্থে জমির দখল পুনরুদ্ধার করতে হয় আইনানুগ প্রক্রিয়ায়, সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় দখল পুনরুদ্ধার মামলা করতে হবে। সেক্ষেত্রে মজার বিষয় হচ্ছে, আপনি যে ওই জমির মালিক সেটা খতিয়ান সূত্রে হোক বা দলিল সূত্রে হোক, তার কোনটাই আপনাকে প্রমাণ করতে হবে না। আপনি শুধুমাত্র ওই জমিতে দখলে ছিলেন, এতোটুকু প্রমাণ করাই আপনার জন্য যথেষ্ট। আপনি আজকে একটি জমি দখলের আছেন এই জমি থেকে আপনাকে আপনার সম্মতি ছাড়া আইনানুগ প্রক্রিয়া ব্যতীত যদি উচ্ছেদ করা হয় বা দখলচ্যুত বা বেদখল করা হয় সেক্ষেত্রে আপনি সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় দখল পুনরুদ্ধারের মামলা করলে আপনি আপনার দখল ফিরে পাবেন। এই ক্ষেত্রে শর্ত গুলো আপনাকে পুনরায় বলছি আপনি মনোযোগ সহকারে খেয়াল করুন।

  • প্রথমতঃ আপনি ঐ জমির দখলে থাকতে হবে অর্থাৎ আপনি দখলে ছিলেন আপনাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আপনি দখলেই ছিলেন না, এমনটা হলে কিন্তু হবে না।
  • দ্বিতীয়তঃ আপনাকে যে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত বা বেদখল করা হয়েছে সেটা আপনার অসম্মতিতে। একদমই স্বাভাবিক, সম্মতি দিয়ে কেউ দখলচ্যুত হয় না।
  • তৃতীয়তঃ আপনাকে যে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত বা বেদখল করা হয়েছে সেটা আইনানুগ প্রক্রিয়ায় করা হয়নি। অর্থাৎ, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেমন আদালতের রায়ের ভিত্তিতে বা প্রশাসনিক উপায়ে আপনাকে উচ্ছেদ না করে অবৈধ উপায়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
  • চতুর্থতঃ আপনাকে যেদিন আপনার জমি থেকে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত বা বেদখল করার ৬ মাসের মধ্যে আপনাকে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় মামলা করতে হবে।

কিন্তু আমরা বাঙ্গালীরা না শুনি আইনের কাহিনী। আমরা দখল পুনরুদ্ধারের মামলা না করে যে ব্যক্তি আমাদেরকে দখলচ্যুত করেছে তার সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে তাকেও আইন বহির্ভূত উপায়ে দখলচ্যুত করার জন্য চেষ্টা করি, প্রয়োজনে পেশীশক্তি দেখাই যেটা আসলেই শারীরিক, মানসিক, আর্থিক সকল দিক থেকে আপনাকে ক্ষতির স্বীকার করবে।
একটা হিসেব মিলিয়ে দেখুন তো, আপনাকে যে দখলচ্যুত করেছে সে যেমন আপনার অসম্মতিতে এবং আইনানুগ প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে আপনাকে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত বা বেদখল করেছে ঠিক তেমনি আপনিও আবার তাকে দখলচ্যুত করতে যাচ্ছেন আইনানুগ প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে এবং অবশ্যই তার বিনা সম্মতিতে। আপনি হয়ত আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘আপনি আমাকে ঐ অসাধু জুলুমবাজ জানোয়ারটার সাথে মিলাচ্ছেন?’

জ্বি মিলাচ্ছি, কারণ কুকুর আপনাকে কামড়ালে, আপনি নিশ্চয়ই কুকুরকেও কামড়ে দেন না। তাইতো কথায় আছে, যেমন কুকুর, তেমন মুগুর। আর জমি হতে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত বা বেদখল হলে আপনার মুগুর হিসেবে কাজ করবে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা। কেননা, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারার নীতিই হচ্ছে, যে দখলে আছে, সেই দখলে থাকবে। আপনি দখলে ছিলেন, বিবাদী আপনাকে দখলচ্যুত করেছে, আপনি মামলা করে আপনার দখল আপনি ফেরত নিবেন। কিন্তু, আপনি দখলে ছিলেন, সে আপনাকে দখলচ্যুত করল, আপনি আবার তাকে দখলচ্যুত করলেন, তখন সে গিয়ে ৯ ধারায় মামলা করল তখন আপনি যে তাকে দখলচ্যুত করেছেন, তার প্রমাণ কিন্তু সে দিতে পারবে। তাই, আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে আইনের আশ্রয় নিন; দেরিতে হলেও আইনই আপনাকে সঠিক ও সুনির্দিষ্ট প্রতিকার দিবে।

specific Relief Act

আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে, ৯ ধারার অধীনে মামলা করার বেলায় এটা মনে রাখতে হবে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য মালিকানার চাইতে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় ‘দখল’কে। আপনার মালিকানার দরকার নেই, দরকার শুধু দখল। আপনি দখলে ছিলেন আর আপনাকে দখল থেকে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত বা বেদখল করা হয়েছে, তাহলেই ৯ ধারায় মামলা করার জন্য যথেষ্ট। কারণ আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, ৯ ধারার নীতি হচ্ছে, ‘যে দখলে আছে, সেই দখলে থাকবে’। কাজেই আপনি জমির দলিল, খতিয়ান, খাজনার কাগজ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি না করে শুধু উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত বা বেদখল হওয়ার আগে আপনি দখলে ছিলেন এতোটুকু হলেই আপনি দখল পুনরুদ্ধারের মামলা দায়ের করতে পারবেন। তবে আপনাকে অবশ্যই তামাদির মেয়াদ ৬ মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। যদি কোন কারণে ৬ মাস অতিক্রান্ত হয়ে যায় অর্থাৎ ৬ মাসের মধ্যে আপনি মামলা করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে আপনি অন্য কোন উপায় বা কোন ধারার অধীনে মামলা করে জমি পুনরুদ্ধার বা দখল পুনরুদ্ধার করতে পারবেন সেই বিষয়ে আমরা আরও একটি অনুচ্ছেদে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো। আজ এই পর্যন্তই, ভালো থাকবেন।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.