জমির দলিল রদ

সাবেক খতিয়ানের মালিক কর্তৃক দলিল বাতিলের মামলা

জমি-জমার আইন

বছর পাঁচেক আগে কাদের সাহেব সুমি বেগমের কাছ থেকে একটি ৫ তলা বাড়ি ক্রয় করেছিলেন। সুমি বেগম বাড়িটি বিক্রি করে পরিবারসহ কানাডায় চলে গেছে আর কাদের সাহেব তার জীবনের পুরো উপার্জন দিয়ে উক্ত বাড়িটি ক্রয় করে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন। সম্প্রতি কাদের সাহেবের মৃত্যুর পর কাদের সাহেবের ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ উত্তরাধিকাররা উক্ত বাড়ির মালিকানা অর্জন করে। এতটুকু পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু লোক কাদের সাহেবের ছেলে মেয়েদের নামে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে। প্রথমে কাদের সাহেবের ছেলেমেয়েরা গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে ওরা আদালত থেকে সমন পাওয়ার মাধ্যমে জানতে পারে যে তাদের নামে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাটি মূলত একটি দেওয়ানি মামলা, যেখানে কাদের সাহেব সুমি বেগমের কাছ থেকে যে দলিল মূলে বাড়ি ক্রয় করেছিলেন সেই দলিলটি বাতিল চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছে।
যেহেতু কাদের সাহেব জীবিত নেই সেক্ষেত্রে ওনার ছেলে মেয়েরা বিষয়টি নিয়ে খুবই বিব্রত হলো পাশাপাশি আতঙ্কিত হওয়া শুরু করল। কেননা কাদের সাহেব নিজে সারা জীবন সৎ ছিলেন এবং কর্মজীবন শেষে সারা জীবনের উপার্জন দিয়ে এই বাড়িটি ক্রয় করেছিলেন। এখন সেই বাড়িটির মালিকানা নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে সেক্ষেত্রে উনার ছেলেমেয়েরা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে আতঙ্কে তারা দিশেহারা হয়ে গেল।

আমাদের সমাজে এই একটি সমস্যা সবচেয়ে বড় যে, কোন একটি মামলা দায়ের করার সাথে সাথে আমাদের অনেকে হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে যায়। মামলা দায়ের করার মানে কিন্তু এই নয় যে তারা মামলাতে রায় পেয়ে গেছে বা যা অভিযোগ করা হয়েছে তা সত্য প্রমাণ হয়ে গেছে। আজকে যে কোন ব্যক্তি চাইলে আমার আপনার নামে যে কোন ধরনের অভিযোগ এনে থানায় বা আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে। কিন্তু মামলা দায়ের করা মানেই কিন্তু এটা নয় যে উক্ত অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে গেছে।
হ্যাঁ এটা ঠিক যে সাময়িক হয়রানি কিংবা মানহানি হয়ে থাকে কিন্তু দিন শেষে মামলাটি যখন ট্রায়ালে যায় তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে মিথ্যা অভিযোগগুলো প্রমাণ করতে না পারার কারণে মামলাটি খারিজ হয়ে যাচ্ছে অথবা তারা যে দাবি করেছিল সেই দাবিটি প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। কিন্তু যতদিন মামলা চলছে ততদিন আপনাকে সে হয়রানিটুকু সহ্য করতে হবে।

মাথায় রাখতে হবে আপনি মশাকে না কামড়ালেও মশা আপনাকে নিজ দায়িত্বে কামড়াবে, ঠিক তেমনি জঙ্গলে গিয়ে আপনি কোন পশুর ক্ষতি না করলেও হিংস্র জন্তু জানোয়ার গুলো আপনার ক্ষতি করার জন্য চলে আসবে। তেমনি আমাদের সমাজে অনেক মানুষ রয়েছে যাদের আপনি কোন ক্ষতি না করলেও তারা আপনার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে, মানহানি করার উদ্দেশ্যে, হয়রানি করার উদ্দেশ্যে, আর্থিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করতে পারে।
তাই যেকোনো ধরনের মামলা মোকদ্দমায় যখনই আপনি জড়িয়ে পড়বেন তখন আমার সাথে কেন এমন হলো, আমি তো কোন অপরাধ করিনি, এই ধরনের কথাগুলো নিজের সাথে নিজে বা পরিবারের সাথে না বলে বরং ঠাণ্ডা মাথায় আইনি প্রক্রিয়ায় মামলাটি মোকাবেলা করা উচিত। দিনশেষে আপনি যখন নির্দোষ প্রমাণিত হবেন তখন যেই ব্যক্তি আপনাকে হয়রানি বা মানহানি বা সামাজিক বা আর্থিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করেছে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযোগ দায়ের করবেন।

এখন কাদের সাহেবের ছেলে মেয়েরা যখন মামলা নথিপত্র তুলে দেখল যে, মামলার বাদী তাদের বিরুদ্ধে যে মামলাটি করেছে সেখানে তাদের যুক্তি হচ্ছে যে, তারা সাবেক খতিয়ান আরএস মূলে উক্ত বাড়ির মালিক। কাদের সাহেবের সন্তানরাও কাগজপত্র ঘেঁটে দেখল যে, ওই ব্যক্তিরা সত্যিকার অর্থে আরএস খতিয়ান মূলে উক্ত বাড়ির মালিক ছিল। কিন্তু তাদের বাড়িটি তারা ব্যাংকে মরগেজ বা বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিল এবং এক সময় ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে ব্যাংক থেকে বাড়িটি নিলামে তোলা হয়। ঐ বাড়ি সুমি বেগম ক্রয় করেছি এবং বাড়ির মালিকানা অর্জন। ক্রয় সূত্রে দলিল এবং দখল সূত্রে খতিয়ান মূলে মালিক হওয়া সুমি বেগমের মালিকানা ছিল বৈধ যা পরবর্তীতে তিনি বৈধভাবে কাদের সাহেবের কাছে বিক্রি করেছেন। সেই সুবাদে কাদের সাহেব নিজ নামে নামজারি করিয়ে ছিলেন। অতএব এক্ষেত্রে কাদের সাহেবের সন্তানদের বৈধ মালিক ধরে নিতে কোন সমস্যা নেই।

বাদী যে মামলা দায়ের করে ছিলেন সেটি হচ্ছে আরএস রেকর্ড অনুসারে বাড়ির মালিকানা দাবী। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, আরএস হচ্ছে সাবেক খতিয়ান, বিএস হচ্ছে সর্বশেষ খতিয়ান। ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে উক্ত দলিল বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাদীর যদি কোন যৌক্তিক কারণ থেকে থাকে যে, আরএস রেকর্ড অনুসারে তারা মালিক এবং বিএস অনুসারেও তারা মালিক হওয়ার কথা ছিল, সেক্ষেত্রে খতিয়ান সংশোধনের মামলা করতে পারতো ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে।

কিন্তু তারা যে দলিল বাতিলের মামলা দায়ের করেছে, সেটিতে ওই দলিল বাতিলের ক্ষেত্রে তাদের যৌক্তিক কোন কারণ ছিল কি ছিল না বা দলিলে বাতিল হবে কি হবে না সেটা আদালতের বিষয়। উপরে ঘটনাটি যেহেতু কাল্পনিক সেই ক্ষেত্রে বাস্তবে ভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।

তবে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি সৎ এবং বৈধ পথে রয়েছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা হয়ে থাকলে ভয় না পেয়ে, নার্ভাস না হয়, হাল ছেড়ে না দিয়ে বরং শক্ত হাতে, ঠাণ্ডা মাথায় আইনি প্রক্রিয়ায় নিজের অধিকারের পক্ষে লড়াই করা উচিত। সত্যের মৃত্যু নেই, শত ধামাচাপা দিয়েও সত্যকে গোপন করা যায় না বা মিথ্যাতে পরিণত করা যায় না। তাই আতঙ্কিত না হয়ে মামলা মোকাবেলা করুন এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে নিজের অধিকার আদায় করুন। ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.