হেবা দলিল

হেবা দলিল করার পর যে প্রতারণা হয়ে থাকে

জমি-জমার আইন

হিরণ সাহেব ব্যবসায়িক কাজে পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন বলে দেশে ওনার নামে যে জায়গা জমি রয়েছে, সেই জায়গা জমি গুলো দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতে তার ভাই লিটন সাহেবকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। বছরের পর বছর বাড়িতে না থাকার কারণে লিটন সাহেব সকল জায়গা জমি নিজের মত করে দেখাশোনা করেন। যদিও কাগজপত্র সবকিছুই হিরণ সাহেবের নামে রয়েছে, কিন্তু দখল এবং দেখাশোনা করতেন লিটন সাহেব।
একসময় বিদেশে ব্যবসার প্রসারের জন্য হিরণ সাহেব চিন্তা করলেন যে নিজের জায়গা জমি গুলো বিক্রি করে দিয়ে বাহিরে একবারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবেন। তাই তিনি ভাই লিটনকে প্রস্তাব দিলেন তুমি যদি আমার জায়গা গুলো কিনে রাখতে পারো সেই ক্ষেত্রে আমার জন্য ভালো হয়। আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি বাহিরের কোন লোক ক্রয় করার চাইতে তুমি ক্রয় করে রাখো, সেই ক্ষেত্রে আমি তোমাকে বিক্রি করে দিলেও ভবিষ্যতে আমি কখনো বাড়ি আসতে চাইলে তোমার কাছে থাকা বা পৈত্রিক সম্পত্তি পুনরায় কখনো দেখার স্বাদ হলে দেখতে পারবো।

স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশে সম্পত্তি বাহিরে কারো কাছে বিক্রি করে দিলে সেই সম্পত্তিতে আর কোনো মতে কোন আবদার, আহ্লাদ করা যায় না। কিন্তু নিজের ক্রয়কৃত বা পৈত্রিক সম্পত্তি নিজের ভাই বোনের কাছে বিক্রি করলে তখন কিছুটা হলেও আবদার করা যায়।
এখানে আবদার বলতে সম্পত্তিতে অধিকারকে বোঝানো হচ্ছে না, আবদার বলতে বোঝানো হচ্ছে পৈত্রিক সম্পত্তিতে অনেক সময় বাবা মা কিংবা দাদা-দাদির লাগানো অনেক ফল গাছ থেকে থাকে, ওই গাছ থেকে ফল খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে পারা কিংবা ওই সম্পত্তিতে নিজের লাগানো গাছ বা সৌন্দর্য বর্ধন থাকতে পারে, সাথে অনেক স্মৃতিও অবশ্যই থাকে, সেগুলো সাময়িক সময়ের জন্য উপভোগ করতে পারাকে বুঝানো হচ্ছে।

অনেকের কাছে শৈশবে যে জায়গায় বড় হয়েছে সেই জায়গার একটা আলাদা নস্টালজিক মূল্য রয়েছে। অনেকেই যে পুকুর ঘাটে প্রথম সাঁতার শিখেছিল সেই পুকুর ঘাটে পুনরায় গিয়ে গোসল করা, সেই পুকুরে আশেপাশে তার পুরনো স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়ানোর অধিকারটুকু আমৃত্যু পেতে চায়। অনেকেই ঢাকা শহরে বাড়ি বিক্রি করে দিলেও বাড়ির ছাদের প্রতি একটা বাড়তি আকর্ষণ অনুভব করেন; পড়ন্ত বিকেলে ঐ ছাদ থেকে আকাশটা দেখতে দেখতে একটু পুরনো কথা মনে করে চোখ ভেজাতে ভালোবাসেন।
এখন ওই পৈত্রিক সম্পত্তি যখন বাহিরের কোন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়ে থাকে, তখন সেই সম্পত্তিতে কখনো এই ধরনের আবদার আহ্লাদ দাবি করা যায় না। আপনিও আপনার বিক্রেতাকে হয়ত এমন সুযোগ দিবেন না, ভাববেন অনধিকার চর্চা। কিন্তু যদি নিজের ভাই বোনের কাছে বা নিজের ভাতিজা, ভাতিজি, ভাগিনা, ভাগিনীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া যায়, সেই ক্ষেত্রে তখন এই অধিকারটুকু দাবি করলে সেটা সাধারণত কেউ ফেলে দেয় না।

যদিও সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে বিক্রি করার জন্য অগ্রক্রয়ের বিধান রয়েছে তারপরও অনেক ব্যক্তি চালাকি করে গোপনে বাহিরে বিক্রি করে থাকে। আবার কিছু ব্যক্তি ব্যতিক্রম রয়েছেন, যারা সম্পত্তি বাহিরে বিক্রি না করে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বিক্রি করার ইচ্ছা পোষণ করে থাকে শুধুমাত্র আবেগকে মূল্য দেওয়ার জন্য।
যাই হোক হিরণ সাহেব যখন লিটন সাহেবের কাছে ওনার সম্পত্তি বিক্রির প্রস্তাব দিলেন, তখন লিটন সাহেব রাজি হলেন। তিনি উক্ত সম্পত্তি হিরণ সাহেবের কাছ থেকে ক্রয় করার জন্য যে মূল্য নির্ধারণ করলেন, সেই মূল্য পরিশোধ করলেন এবং হিরণ সাহেব দেশে এসে নিজ ভাইকে ওই সম্পত্তি লিখে দিয়ে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে যান।
সাফ কবলা দলিলের রেজিস্ট্রেশন খরচ অনেক বেশি, প্রায় ১০ শতাংশে আশেপাশে। রেজিস্ট্রেশন খরচ বেশি হচ্ছে বলে, দলিল লেখকের পরামর্শে হিরণ সাহেব রেজিস্ট্রেশন খরচ বাঁচানোর জন্য লিটন সাহেবকে হেবা দলিল করে দেয়। এরপর থেকে লিটন সাহেব উক্ত সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করে ভোগ দখল করতে থাকেন।

বছর ঘুরতে না ঘুরতে ঘটনাচক্রে হিরণ সাহেব বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে মার খেয়ে একবারে পরিবার নিয়ে দেশে চলে আসেন। দেশে এসে যখন ভাইয়ের কাছে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন লিটন সাহেব স্বাভাবিকভাবে থাকতে দিলেও অধিকার বলে কোন কিছুতে ঘর করে থাকার সুযোগ দেননি, যেহেতু তিনি উক্ত সম্পত্তি ক্রয় করে নিয়েছেন।
কিছু দিন যেতে না যেতেই নিরুপায় হয়ে বা কিছু লোকের কুবুদ্ধিতে অথবা ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’ বলে যেটা বুঝায় সেটি ভর করায় হিরণ সাহেব আদালতে হেবা দলিল বাতিল করার মামলা দায়ের করেন। আমরা জানি যে, হেবা দলিল সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা অনুযায়ী বাতিলের আবেদন করা যেতে পারে।

উক্ত মামলায় হেবা দলিল বাতিল হবে কি হবে না, সেটি এখন আদালত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে নির্ধারণ করবেন। কিন্তু, এখন কথা হচ্ছে যদি কোন কারণে হেবা দলিলটি সত্যিকার অর্থে বাতিল হয়ে যায়, সেই ক্ষেত্রে এই যে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি রয়েছে, সেই বিষয়টি নিয়ে লিটন সাহেব বেশ ঝামেলা পড়ে যাবেন।
কারণ হেবা দলিলে আমরা জানি কোন ধরনের লেনদেন হয় না। সম্পত্তি হেবা করা হয়ে থাকে, কোন প্রকার বিনিময় বা লেনদেন ব্যতীত। কিন্তু লিটন সাহেব তো হিরণ সাহেবকে ন্যায্য মূল্য দিয়েই জমি ক্রয় করেছিলেন।

হেবার শর্তগুলোতে আমরা দেখেছি, কোন মুসলিম ব্যক্তির দ্বারা সম্পত্তি হেবার জন্য অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে, হেবা দলিল করার ক্ষেত্রে কোন প্রকার বিনিময় থাকতে পারবে না। যদিও আমরা জানি, ‘No consideration, no contract’, অর্থাৎ, বিনিময় বা লেনদেন না থাকলে কোন চুক্তি সম্পন্ন হয় না। কিন্তু, হেবার ক্ষেত্রে দাতা এবং গ্রহীতার মাঝে কোন প্রকার বিনিময় থাকতে পারবে না।

কিন্তু, আমাদের দেশে রেজিস্ট্রেশন খরচ বাঁচানোর জন্য টাকা দিয়ে সম্পত্তি ক্রয় করার পরও আত্মীয় স্বজন থেকে আমরা সাফ কবলা দলিল না করে হেবা দলিল করে থাকি, যা ভবিষ্যতে কখনো কখনো উপরের ঘটনার মত বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই, সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিতে গিয়ে নিজেই ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন কিনা সেটা চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করুন হেবা দলিল করবেন নাকি সাফ কবলা দলিল করবেন?

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.