অপরাধ সংঘটনের উদ্যোগ

অপরাধ সংঘটনের উদ্যোগ এবং কিছু কথা

ফৌজদারি আইন

একবার এক মুরুব্বী আংকেল ফার্মেসিতে ওষুধ কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। দোকানদারকে স্লিপ দিয়ে বিভিন্ন ওষুধের পরিমাণ বলছেন আর দোকানদারও স্লিপ অনুসারে এক একটা ওষুধ নামিয়ে নামিয়ে আনছেন। এমন সময় এক চোর মুরুব্বী আংকেলের পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো চুরির মতলবে। চোর অতি সাবধানে হাত ঢুকিয়ে যেই মাত্র মুরুব্বীর পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি ধরতে গেলো, সেই মাত্র মোবাইলটি বেজে উঠলো, অর্থাৎ মুরুব্বীর মোবাইলে কল এসেছিল। কথায় বলে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। মোবাইল বাজার শব্দে মুরুব্বী যেই মাত্র পকেটে দিকে হাত বাড়ালেন, চোরের হাতের স্পর্শ পেয়ে চোরকে হাতে নাতে ধরে ফেললেন। যেই ধরা সেই কাজ, কোথা থেকে যে এতো মানুষ এসে হাজির হল, কে জানি। এলোপাথাড়ি চারদিক থেকে এসে কত যে কিল, ঘুষি, লাত্থি আর চুল ধরে এদিক ঐদিক হ্যাঁচকা টান মেরে চোরের নাজেহাল অবস্থা করেছে, সেটি শুধু চোখে দেখলেই বুঝা যায়, অন্যথায় নয়। এই যে বিচার বহির্ভূত হত্যা কাণ্ড সেটি অবশ্যই অন্যায়। সবারই আদালতের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করার অধিকার রয়েছে, তাই চোর হোক বা ডাকাত; সবার বিচারের সম্মুখীন হয়ে নিজেকে আত্মরক্ষা করার মত ব্যবস্থা করে দিতে হবে, তারপর আদালতের আদেশ অনুযায়ী যদি দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে শাস্তি ভোগ করবে, নয়ত নির্দোষ প্রমাণিত হলে খালাস পাবে। কিন্তু, কেউ যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তাহলে তাকেও আইনের আওতায় আনা উচিত। কেননা, আমরা জানি যে, একমাত্র আত্মপক্ষ সমর্থন/ প্রাইভেট ডিফেন্সের অধিকার চর্চা করার সময় যেমন, নিজের শরীর এবং সম্পদের উপর যখন হামলা চালায়, তখন চাইলে আপনি আত্মপক্ষ সমর্থন/প্রাইভেট ডিফেন্স করার জন্য আক্রমণকারীকে আঘাত করতে পারবে এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতে পারবে। কিন্তু, এভাবে রাস্তা ঘাটে কাউকে চোর আখ্যা দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিলে সেটিও আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দেয়। চোর সন্দেহে সাভারের আমিনবাজারের ঘটনা জানা থাকলে আপনি নিজেও আমার সাথে একমত হবেন যে, চোর সন্দেহে কখনো আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। যাই হোক, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া নিয়ে অন্য আরেকদিন জানবো। আজকে আমরা জানবো, অপরাধ সংঘটনের সকল উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও যদি অপরাধটি সংঘটন না হয়, তখন তাকে বলা হয় অপরাধ সংঘটনের উদ্যোগ (attempt to commit offences) এবং এর বিস্তারিত।

আমরা উপরে যে ঘটনাটি বললাম, চলুন সেই ঘটনাতেই আবার ফিরে আসি। ধরুন, মুরুব্বী আংকেলের পকেটে চোর হাত ঢুকিয়েছে কিন্তু মুরুব্বীর পকেটে কিছুই ছিল না। চোরের যেহেতু অভিপ্রায় ছিল চুরি করা এবং সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মুরুব্বীর পকেটে হাত ঢুকিয়েছে, তবে কিছু না পাওয়াতে সে চুরিতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু, পকেটে কিছু থাকলেই সেটি চুরি করা সম্ভব হতো। এমতাবস্থায় আপনি তাকে চোর বলতে পারবেন কিনা সেটি আইনত বলা মুশকিল। তবে, এটিকে অপরাধের ভাষায় আপনি চুরির উদ্যোগ (attempt to theft) বলতে পারবেন; যেমনটা, আমরা খুনের উদ্যোগ (attempt to murder) বলে থাকি।

অপরাধ সংঘটন আর অপরাধ সংঘটনের উদ্যোগের মধ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে। একটিতে অপরাধ সংঘটন হয়, অন্যটিতে অপরাধ সংঘটন হয় না। কিন্তু, উভয় ক্ষেত্রে প্রস্তুতি, প্রচেষ্টা, অভিপ্রায় সবই একই থাকে, শুধু কার্যকর করতে গিয়ে একটি সফল হয়, অন্যটি ব্যর্থ হয়। আমরা সহজ ভাষায় বললে, কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে কোন কর্মকাণ্ড করে থাকলে সেটি যদি তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে সেটি অপরাধ সংঘটন হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু, যদি অভিপ্রায় থাকা সত্ত্বেও সকল কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠার পরও যদি অপরাধটি বাস্তবায়ন সম্ভব না হয়, তবে সেটিকে বলা হয় অপরাধ সংঘটনের উদ্যোগ (attempt to commit offences)।

 

অপরাধ সংঘটনের প্রচেষ্টা বা উদ্যোগের জন্য কোন ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা যাবে যদি,

  • অপরাধী ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনের কোন প্রচেষ্টা করে,
  • অপরাধী ব্যক্তি যে অপরাধ সংঘটনের কোন প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ গ্রহণ করে, তা দণ্ডবিধির অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং উক্ত অপরাধের জন্য দণ্ডবিধিতে বর্ণিত যেকোনো শাস্তির বিধান রয়েছে যা কিনা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
  • অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনের জন্য কোন অপকর্ম (act or ommision) সম্পাদন করবেন।

 

অপরাধ সংঘটনের প্রচেষ্টা বা উদ্যোগের জন্য কোন ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা যাবে যদি সেই সম্বন্ধে আইনে সুস্পষ্ট বিধান থাকে। কিন্তু, যদি আইনে সুস্পষ্ট বিধান না থাকে তাহলে অপরাধী যে অপরাধ সংঘটনের প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, সেই অপরাধের জন্য নির্ধারিত যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ড যার মেয়াদ উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ মেয়াদের কারাদণ্ডের অর্ধেক কারাদণ্ড বা অর্থ দণ্ড বা উভয় দণ্ড। অর্থাৎ, যদি কোন নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য অপরাধ সংঘটনের উদ্যোগ (attempt to commit offences)’এর শাস্তির বিধান দেওয়া থাকে, তাহলে তো সেই অনুপাতেই শাস্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু, যদি কোন অপরাধের জন্য অপরাধ সংঘটনের উদ্যোগ (attempt to commit offences)’এর শাস্তির বিধান দেওয়া থাকে, তাহলে ঐ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যে শাস্তির বিধান রয়েছে, সেটির অর্ধেক প্রদান করা হবে। যেমন ধরুন, চুরির উদ্যোগের জন্য কোন শাস্তির বিধান দেওয়া নেই, তাই কেউ যদি চুরির উদ্যোগ গ্রহণ করে যা কিনা চুরির অপরাধ নয়, তাহলে সে ব্যক্তি চুরির সর্বোচ্চ শাস্তি যেহেতু ৩ বছর, সেহেতু চুরির উদ্যোগ গ্রহণের অপরাধের জন্য চুরির শাস্তির অর্ধেক অর্থাৎ ৩ এর অর্ধেক দেড় বছর প্রদান করা হবে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.