ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: পর্ব ৩

ফৌজদারি আইন

এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। কিন্তু বিশাল এই ব্যবহারকারীর মধ্যে একটা বড় অংশ রয়েছে ফেইক বা ভুয়া একাউন্টধারী। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফেসবুকের নিজস্ব প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেসবুকের মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে ১১.৫% একাউন্ট ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও প্রতিনিয়ত ফেসবুক বিভিন্ন ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিচ্ছে, কিন্তু তার পরেও ভুয়া অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কোন মতেই কমছে না। ফেসবুকও বলছে ভুয়া অ্যাকাউন্ট গুলো বন্ধ করা বা যাচাই করা এতটা সহজ নয়। শুধুমাত্র স্প্যাম আইডিগুলো তারা বন্ধ করতে সক্ষম হচ্ছে। আর স্প্যাম আইডি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তারা ঐ ধরনের আইডি গুলোকে চিহ্নিত করছে, যেগুলোর মাধ্যমে অপপ্রচার বা সমাজে উস্কানি মূলক তথ্য বা খবর শেয়ার করা হয় বা ছড়ানো হয়; সেই ধরনের আইডিগুলো ফেসবুক কর্তৃপক্ষ থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।

 

নিছক মজার ছলে বিভিন্ন রূপক নাম ব্যবহার করে যারা ফেসবুকে ভুয়া আইডি বা ফেইক আইডি ব্যবহার করে, তাদের বিষয়টা হালকা ভাবে নেওয়া গেলেও যখন কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি সেটা রাজনৈতিক হোক বা ধর্মীয় বা অন্য যে কোন ব্যক্তিত্বের নাম ব্যবহার করে বা উদ্দেশ্য করে অন্যকেও সেই আইডি ব্যবহার করে সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালায়, সে ক্ষেত্রে সেই আইডিটি একটি সমাজের দাঙ্গা থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। ব্যক্তিগতভাবে যে ব্যক্তির নামে ফেইক আইডি খোলা হচ্ছে তার মানহানি করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ওই ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে অন্য কারো সাথে সম্পর্কে উষ্ণতা তৈরি বা সমাজ ব্যবস্থার অবনতির জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। কিছুদিন আগেও একটি দৈনিকে দেখা গিয়েছে যে, কুমিল্লা জেলার একজন ইউপি চেয়ারম্যানের নামে ভুয়া আইডি খুলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এই যে রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের একজন স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি নাকে ফেইক আইডি ব্যবহার করে সমাজে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, এতে বুঝা যায় যে, ফেসবুক যতটা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছেছে, ঠিক ততটাই ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে রয়েছে যদি এর সঠিক ব্যবহার করা না হয়। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগের যে মাধ্যম গুলো রয়েছে, সেগুলো যদি সঠিক ভাবে ব্যবহার না হয় সে ক্ষেত্রে সেটি যদি উল্টো অপপ্রচার প্রোপ্যাগান্ডা কাজে ব্যবহার করা হয় সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের আশীর্বাদের পরিবর্তে অভিশাপ হিসেবে কাজ করবে। তাছাড়া এখন সিটিজেন জার্নালিজম বলে যে বিষয়টা রয়েছে, সেটি ধীরে ধীরে আমাদের দেশে গুরুত্ব পাচ্ছে। আমরা আমাদের চারপাশের যে ধরনের ঘটনাগুলো দেখি, সেগুলোকে আমরা ফেসবুক, ইউটিউব এর মাধ্যমে পুরো দেশের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি, যেগুলো কিনা জাতীয় দৈনিক বা গণমাধ্যম এর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যার কারণে সিটিজেন জার্নালিজমের মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজের খুঁটিনাটি যে সমস্যাগুলো হচ্ছে, সেগুলো তুলে ধরতে পারছি। কিন্তু যদি সেগুলো আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার না করে, উল্টো সেটাকে কোন একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কোন একটি মহলকে খুশি করার জন্য বা কোন একটি মহলকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নিজেদের মতো করে মনগড়া, মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করি, তখন সেটা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। যেহেতু আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত আইডি থেকে বা নিজের পরিচয় প্রকাশ্যে এনে, এই ধরনের অপপ্রচার গুলো আমরা চালাই না, বরং প্রত্যেকেই সে ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করে থাকি সে ক্ষেত্রে এই ছদ্মনাম ব্যবহার করা বা যাকে আমরা ভুয়া আইডি বা ফেইক আইডি বলে জানে, তা ব্যবহার করে সমাজে অপপ্রচার বা মিথ্যা তথ্য বা মানহানিকর কোনো তথ্য বা উস্কানিমূলক যদি কোনো তথ্য প্রচার করে থাকি সেটা অবশ্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অপরাধ হবে।



আমরা অনেক সময় দেখে থাকি যে, ফেসবুকে অবুঝ বালক, বুঝ বালক, চাঁদনী রাতের তারা, এ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে বিভিন্ন ফেসবুক আইডি নানা ধরনের রাজনৈতিক, ধর্মীয় পোস্ট করে থাকে, যদি সেটা আপত্তিকর না হয় তাহলে সেটা নিয়ে আমরা কথা বলছি না। কিন্তু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই ধরনের ফেইক আইডি গুলো ছদ্মনাম ব্যবহার করে কোন একটা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য কোন একটি ধর্মকে বা কোন একটি রাজনৈতিক দলকে বা কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি কে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তাকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালাতে থাকে, এই ধরনের অপপ্রচার বন্ধ করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৪ ধারায় পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণকে আইনানুগ অপরাধ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছেকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে অর্থাৎ জেনে শুনে কোন কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করে,
● প্রতারণা বা ঠকানোর উদ্দেশ্যে অপর কোন ব্যক্তির পরিচয় ধারণ করে বা অন্য কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য নিজের বলে প্রদর্শন করেন
● যদি কোন ব্যক্তি
○ নিজের বা অন্য কোন ব্যক্তির সুবিধা লাভ করা বা করিয়ে দেওয়ার জন্য,
○ কোন সম্পত্তি বা সম্পত্তির স্বার্থ প্রাপ্তির জন্য,
○ অপর কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসত্তার রূপ ধারণ করে কোন ব্যক্তি ব্যক্তিসত্তার ক্ষতিসাধন করার জন্য,
উদ্দেশ্যমূলক ভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা নিজের বলে ধারণ করলে সেটা নিজের বা অন্য কোনো ব্যক্তির সুবিধা লাভের জন্য করা হলে সেটি ২৪ ধারার অধীনে একটি অপরাধ।

২৪ ধারায় বর্ণিত উপায়ে কোন ব্যক্তি যদি প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ করে, তবে সেই ব্যক্তি অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি যদি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারংবার করে থাকেন, সেক্ষেত্রে অনধিক ৭ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
অতএব সাধু সাবধান৷ ফেইক আইডি থেকে থাকলে আজই তা ডিলিট করে দিন আর আপনার পরিচিত অপরিচিত যারা ফেইক আইডি ব্যবহার করে থাকেন, তাদেরকেও এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন যাতে মজার ছলে ফেসবুক চালাতে এসে ভবিষ্যতে জেল, জরিমানার মতো ঝামেলায় পড়তে না হয়।

 

[ বাকি পর্বগুলোঃ পর্ব ১পর্ব ২  ]

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.