পুরুষ নির্যাতন আইন

নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের নামে পুরুষ নির্যাতন এবং প্রতিকার

ফৌজদারি আইন

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে’ নারী ও শিশু নির্যাতনের যত মামলা দায়ের করা হয় তার সিংহভাগ মামলাতেই আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ। কিন্তু, তারপরও দেশের যেকোনো প্রান্তেই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোন সাংসারিক বিরোধ হলেই সেটি যদি তালাক পর্যন্ত গড়ায় তাহলে বেশির ভাগ স্ত্রী নিজ বুদ্ধিতে হোক বা অন্যের উস্কানিতে, চলে যাবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। মামলা একটা ঠুকে দিবেই, এটা এখন ডিভোর্সের একটা বাই প্রোডাক্ট, অর্থাৎ তালাক হলে সাথে আপনাআপনিই নারী নির্যাতনের মামলা হবে।
নারী নির্যাতন বলতে নারীর প্রতি যতগুলো অত্যাচার করা বুঝায়, তার প্রতিটিই আমাদের ঘটেছে এবং এখনো ঘটে যাচ্ছে। ২০০০ সালে এই আইনটা করার আগে সত্যিকার অর্থেই নারীর প্রতি একটা হীন মানসিকতা ছিল আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের। অনেক নারীই আমাকে থামিয়ে দিয়ে হয়ত বলবেন, মানুষ বলছেন কেন, পুরুষ বলুন। নারীকে পুরুষ যতটা নির্যাতন করে তারচেয়ে বেশি নির্যাতন করে নারী নিজে নারীকে। আপনি জরিপ চালিয়ে দেখুন, প্রকৃত নারী নির্যাতনের শিকার নারীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখুন গিয়ে, একটা বিশাল অংকের নারীর মুখ থেকে শুনবেন, তারা হয় শাশুড়ি বা ননদের অত্যাচারে জর্জরিত অথবা শাশুড়ির ইন্ধনে স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত। স্বামী কারো কোন ইন্ধন ছাড়া স্ত্রীর উপর হাত উঠায় না, এটা কিন্তু আমি বলছি না। তবে, সংখ্যাটা যে পরিমাণে কম; এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
নির্যাতন যেভাবেই হোক, স্ত্রীরাই তো নির্যাতিত হচ্ছে, তাহলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের নামে পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে; এটা কেন শিরোনামে লিখলেন?- প্রশ্ন করতেই পারেন। উত্তর এক লাইনে দেওয়া সম্ভব না। আসুন একটা একটা পয়েন্ট করে বলি, ২০০০ সালের আগে নারী নির্যাতনের যতো অভিযোগের হিড়িক পড়েছিল, তারচেয়ে এখন অনেক বেশি হারে কেন অভিযোগ হচ্ছে, এটা নিয়ে ভেবেছেন কখনো? আইন হওয়ার আগে অপরাধ হয়েছিল, এটা সত্য। কিন্তু আইন প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর থেকে এই আইনের অধীনে বর্ণীত অপরাধ গুলো দপায় দপায় কমে যাওয়ার কথা, কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। এখন বরং যত একদিন যাচ্ছে মামলার সংখ্যা ততো বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এতে কি কিছুটা হলেও এই ইঙ্গিতটা পাওয়া যায় না যে, আইন আসার পর ভুক্তভোগীদের যতটা না উপকার হয়েছে, তারচেয়ে বেশি উপকার হয়েছে, সুযোগ সন্ধানীদের জন্য। এখন আসুন আমরা জানি কারা এই সুযোগ সন্ধানী?
আপনি একটু চোখ কান খোলা রাখলেই আশেপাশের অনেক গুলো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝতে পারবেন যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন হওয়ার পর থেকে নারীদের যে কিছুটা হলেও সহনশীলতা হ্রাস পেয়েছে, তা টের পাবেন। আগে স্ত্রীরা স্বামীর শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতো সন্তানের দিকে তাকিয়ে, আবার শাশুড়ির ইন্ধন সহ্য করতো, শাশুড়ির বয়স হয়েছে, বাঁচবে আর কয়দিন, এই যুক্তি নিয়ে। আবার অনেকেই আছে শাশুড়ির সাথে সমস্যা হলে আলাদা হয়ে যেত, তারপরও বিচ্ছেদকে একমাত্র উপায় হিসেবে ভাবতো না। কিন্তু, এখন শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও কেবল মতের অমিল হওয়া বা তথাকথিত এডজাস্ট করতে না পারার অভিযোগেই তালাক হয়ে যাচ্ছে। স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের মিথ্যা মামলা বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিভিন্ন মামলা ঠুকে দিচ্ছে। প্রথম দিকে বাবার বাড়ি আর পরিচিত মামা, চাচা, আত্মীয় স্বজন খুব উৎসাহ দেয়, টাকা পয়সা খরচ করে মিথ্যা সাক্ষ্যও জোগাড় করে। যদিও শেষ পর্যন্ত মামলা আর প্রমাণ করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ যতজনকে পারে সবাইকেই মামলার আসামী বানিয়ে পেলে, কিছুদিন হয়রানী করে, জামিন পেতে বাঁধা দেয়, তারপর একে একে চার্জশীটে যত অভিযোগ আছে সবগুলো যখন সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন বাদিনী ধীরে ধীরে আদালতের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তখন এক ডেট, দুই ডেট মামলাতে উকিলকে টাকা দিয়ে হাজিরা দিয়ে সময়ের আবেদন করে কোর্টে অনুপস্থিত থাকতে শুরু করে। একসময় মামলা প্রমাণে ব্যর্থ হয়ে আসামীকে খালাস দিয়ে দেওয়া হয়। তখন যাবতীয় ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেয়ে কথিত আসামী আর আদালতের পাণে চায় না। যদি চাইতো তাহলে অবশ্যই বাদিনীকে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগে শাস্তি দিতে পারত।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে,“যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোন ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করে বা করায়, তাহলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করেছেন, উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।” – অনধিক ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড, অর্থাৎ ৭ বছরের বেশি নয় এমন দণ্ড তবে অবশ্যই সশ্রম মানে যেখানে পরিশ্রম করানো হবে। সাথে অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হতে হবে।

অনেকেই অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না যে, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হলে তার করণীয় কি?- করণীয় একটাই, আগে মামলায় হাজির হও, জামিন করাও, তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করো, এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় বাদিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগে লিখিত অভিযোগ দায়ের করো। বাকী শিক্ষাটা বাদিনীকে আদালতই শিখিয়ে দিবে। এই একটি ধারাই পারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনকে অপব্যবহারের হাত থেকে রক্ষা করতে; আর একই সাথে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের নামে পুরুষ নির্যাতন বন্ধ করতে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.