সাজা মওকুফ

সাজা প্রাপ্ত আসামীর দণ্ড স্থগিত/হ্রাস বা মওকুফ

ফৌজদারি আইন

একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যখন যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত দোষী সাব্যস্ত করে তখন আদালত ঐ অভিযুক্ত ব্যক্তির কৃত অপরাধের ভিত্তিতে যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ড দিয়ে থাকেন। তা যেকোনো বর্ণনার হতে পারে, একেবারে ২৪ ঘণ্টার জেল থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিতে পারে। সেই ক্ষেত্রে উক্ত অপরাধীকে আদালতের দেওয়া শাস্তি ভোগ করতে হবে যদি না অপরাধী আপিলের মাধ্যমে উক্ত সাজা মওকুফ করতে পারেন বা হ্রাস করতে পারেন। তবে, আদি আদালতে বা আপিল আদালতে কোন মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর যদি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয় সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে যে দণ্ড ঘোষণা করা হয় সেই দণ্ড সরকার এবং রাষ্ট্রপতি চাইলে স্থগিত বা মওকুফ কিংবা হ্রাস করতে পারেন। দেশের যেকোনো প্রান্তের, যেকোনো স্তরের অপরাধীকে কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল বা অন্য যেকোনো কর্তৃপক্ষ যখন কোন দণ্ড প্রদান করেন, সেই দণ্ড আদালতের সকল কার্যপদ্ধতির অবসানের পর সরকার এবং রাষ্ট্রপতি চাইলে বাংলাদেশের সংবিধান, দণ্ডবিধি ১৮৬০, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর বিধান অনুসারে উক্ত অপরাধীর দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ বা হ্রাস করতে পারেন। কিন্তু উক্ত তিন আইনে ভিন্ন ভিন্ন বিধান রয়েছে যা নিম্নে আমরা অনুচ্ছেদ এবং ধারা বিশ্লেষণ করে আলোচনা করব।

সংবিধান দণ্ডবিধি ১৮৬০ ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে,  গণআদালত ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যেকোনো ধরনের ক্ষমা/ মার্জনা বিলম্ব এবং বিরাম মঞ্জুর করার এবং যেকোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে। এখানে অপরাধীর দণ্ড মওকুফ বা স্থগিত বা হ্রাস করার যে ক্ষমতা তা শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতিকে প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং সংবিধানের বিধান বা অনুচ্ছেদ অনুসারে সরকার চাইলে কখনো কোন অপরাধীকে আদালত কর্তৃক ঘোষিত দণ্ড মওকুফ বা স্থগিত বা হ্রাস করাতে পারবে না। সংবিধানের ৪৯ অণুচ্ছেদ অনুসারে, শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি চাইলে এই ক্ষমতা চর্চা করতে পারবেন। দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৫৪ এবং ৫৫ ধারায় সরকারকে দণ্ড হ্রাস করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে ৫৪ ধারা অনুসারে সরকার মৃত্যুদণ্ড হ্রাস করে দণ্ডবিধিতে উল্লেখিত যেকোনো কারাদণ্ড প্রদান করতে পারে। অন্যদিকে দণ্ডবিধির ৫৫ ধারায় সরকার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে কমিয়ে অনধিক বিশ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে সরকার অপরাধীর সাথে কোন প্রকারের যোগাযোগ না করে অর্থাৎ অপরাধীর সম্মতি ব্যতিরেকেই সরকার এই কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।

পাশাপাশি ৫৫ ক ধারাতে বলা হয়েছে ৫৪ এবং ৫৫ ধারায় যাহা কিছুই থাকুক না কেন তা কোনোভাবেই রাষ্ট্রপতির যে, মার্জনা করার ক্ষমতা রয়েছে তাকে খর্ব করবে না।

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৪০১, ৪০২, ৪০২ক এই ৩ টি ধারা হচ্ছে, দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ বা হ্রাস সংক্রান্ত।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় সরকার কোন দণ্ডিত আসামিকে তার দণ্ড কার্যকর স্থগিত করতে পারে বা শাস্তির যে কোন অংশ বা সম্পূর্ণ অংশ মওকুফ করতে পারেন। অন্যদিকে সরকার ৪০২ ধারায় দণ্ড হ্রাস বা পরিবর্তন করে অন্য যে কোন দণ্ড দিতে পারেন। উক্ত ধারায় অর্থাৎ ৪০২ ধারায় বলা হয়েছে যে, সরকার দণ্ডিত ব্যক্তির সম্মতি ছাড়াই নিম্নলিখিত যে কোনটি রদবদল করে ইহার পরে উল্লিখিত যেকোনো দণ্ড দিতে পারবেন।

মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আসামী সে সময়ের জন্য দণ্ডিত হতে পারত তার অনধিক সময়ের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড, অনুরূপ মেয়াদের জন্য বিনাশ্রম কারাদণ্ড, জরিমানা ।

৪০২ (২) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ধারাটি কোন ভাবেই দণ্ডবিধির ৫৪ বা ৫৫ ধারা আক্রান্ত করবে না এবং সবশেষে ৪০২ক ধারায় বলা হয়েছে যে, ৪০১ এবং ৪০২ ধারায়, সরকারকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে, মহামান্য রাষ্ট্রপতিও একই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।

সংবিধান, দণ্ডবিধি এবং ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান পর্যালোচনা করলে আমরা যেটা দেখতে পাই তা হচ্ছে, অপরাধীর সাজা বা দণ্ড ক্ষমা করার জন্য ক্ষমা করার যে ক্ষমতা রয়েছে, তা সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধিতে। দণ্ডবিধিতে সরকারকে শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ডের সাজা হ্রাস করে অন্য যেকোনো দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হ্রাস করে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে ফৌজদারি কার্যবিধিতে সরকার চাইলে দণ্ড কার্যকর স্থগিত বা দণ্ড মওকুফ করতে পারে। সেই দিক বিবেচনায় দণ্ডবিধিতে সরকারের ক্ষমা করার যে পরিধি তা খুবই সংকীর্ণ আর ফৌজদারি কার্যবিধিতে ক্ষমা করার পরিধি বেশ ব্যাপক। যদিও রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারার যে ক্ষমতা তা সংবিধান, দণ্ডবিধি এবং ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে উল্লেখ করা আছে, কিন্তু সরকার ক্ষমা প্রদর্শন করার অধিকার শুধুমাত্র দণ্ডবিধি এবং ফৌজদারি কার্যবিধিতে থেকে পাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, ক্ষমা করার ক্ষমতা সরকারের তুলনায় রাষ্ট্রপতি বেশি।

দণ্ডপ্রাপ্ত কোন অপরাধের দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ বা হ্রাস করার যে ক্ষমতা রয়েছে, তা দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যেমন করা যায়, ঠিক তেমনি সরকার নিজ উদ্যোগেও কোন অপরাধের সাজা স্থগিত বা মওকুফ বা হ্রাস করতে পারেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ এবং ৪০২ ধারা অনুসারে সরকার বিশেষ দিবসগুলোতে যেমন স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় এনে তাদের দণ্ড মওকুফ করে দিয়ে তাদেরকে মুক্ত করে দিতে পারেন। এই হচ্ছে, সাজা প্রাপ্ত আসামীর দণ্ড স্থগিত বা হ্রাস বা মওকুফ সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। ভবিষ্যতে আমরা আরও বিস্তারিত লেখা চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্‌। আজ এই পর্যন্তই, আল্লাহ্‌ হাফেজ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.