The Penal Code, 1860 | 144

১৪৪ ধারা – কি, কেন, কিভাবে?

ফৌজদারি আইন

কি?
কিছু কিছু ধারা এতটাই জনপ্রিয় বা মানুষের মুখে মুখে এতোটাই পরিচিতি লাভ করে যে, ওই ধারাগুলোকে মানুষ স্বতন্ত্র ভাবেই চিনে থাকে। উক্ত ধারা কোন আইনের ধারা সেটি পর্যন্ত অনেক সময় অজানা থেকে যায়; ১৪৪ ধারা সেই রকমই একটি ধারা। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৪৪ ধারার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে জনসাধারণের শান্তির ব্যাঘাত ঘটতে পারে বা জীবন, স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে এমন সম্ভাবনা তৈরি হলে, ওই এলাকাতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনসমাগম বা কোন প্রকারের সমাবেশ করতে না পারে, সেই বিষয়ে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা। এটিকে Preventive Measures প্রিভেন্টিভ মেজার বলা যেতে পারে, কেননা কোন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা হওয়ার পূর্বেই ওই স্থানকে নিরাপদে রাখার নিমিত্তে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়ে থাকে।

 

কেন?
ধরুন আপনার এলাকাতে একটি বিশাল মাঠ রয়েছে, যেখানে একই দিনে দুইটি রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশের আহ্বান করা হয়েছে। এমন অবস্থায় আপনি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে নিজেই উপলব্ধি করতে পারছেন যে, উভয় দল একই সাথে সভা সমাবেশ করতে পারবে না, কেননা করতে গেলে নির্ঘাত দাঙ্গা-হাঙ্গামা হবে। যদি ধরে নেই যে একটি দলকে প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে অন্য দলকে অনুমতি দেয়নি, সেই ক্ষেত্রেও যারা অনুমতি পায় নি তারা যে অনুমতি প্রাপ্ত দলের সভা সমাবেশে হামলা করবে না, তার কি কোন নিশ্চয়তা রয়েছে?- সেই ক্ষেত্রেও এক ধরনের দাঙ্গা হাঙ্গামা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সভা সমাবেশ নয়, এমনকি কখনো কখনো শুধুমাত্র খেলার আয়োজনকে কেন্দ্র করে কিংবা ওয়াজ মাহফিল কে কেন্দ্র করেও দাঙ্গা হাঙ্গামা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে থাকে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত জনসাধারণের শান্তির ব্যাঘাত ঘটে বা নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়, তাই এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পূর্বেই যাতে এই ধরনের কোন সভা সমাবেশ বা জনসংগম বা অপ্রীতিকর ঘটনা বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতে না পারে সেই কারণেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়ে থাকে।

 

কিভাবে?
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করার যে আদেশ, সেটি প্রদান করার এখতিয়ার সাধারণত শুধুমাত্র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের রয়েছে।
প্রথমত, ডিসি বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারা জারি করতে পারেন,
দ্বিতীয়ত, সরকার বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত অন্য যে কোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারা জারি করতে পারেন।
এখানে মনে রাখতে হবে যে, ম্যাজিস্ট্রেট বললেই আমরা অনেক সময় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের কথা স্মরণ করি, এখানে পরিপূর্ণভাবে বলা হয়েছে ১৪৪ ধারা জারি করতে পারবেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট; কোনমতেই কোন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারা জারি করতে পারবেন না। এই ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের যে ক্ষমতা সেটি হচ্ছে Discretionary/ ডিসক্রিশনারি ক্ষমতা অর্থাৎ তিনি ইচ্ছে করলে জারি করতে পারেন আবার ইচ্ছা না করলে জারি নাও করতে পারেন।

১৪৪ ধারা সাধারণত দুই মাসের বেশি কার্যকর বা বলবৎ থাকে না। অর্থাৎ আজকে যদি কোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আপনার এলাকার কোন নির্দিষ্ট স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করেন সেই ক্ষেত্রে সেটি সর্বোচ্চ আগামী দুই মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। কিন্তু সরকারের যদি মনে হয় যে, আপনার এলাকার ঐ নির্দিষ্ট স্থানে মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার নিয়ে কোন আশঙ্কা রয়েছে বা কোন দাঙ্গা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই ক্ষেত্রে সরকার গ্যাজেট প্রকাশের মাধ্যমে ১৪৪ ধারার বলবতের যে সময়কাল সেটি বর্ধিত দিতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে দুই মাসের বেশি যে সময়টি বর্ধিত করা হবে সেই ক্ষমতা রয়েছে শুধুমাত্র সরকারের এবং সেটি সরকার গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে থাকেন।

কোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিসি যদি আপনার এলাকাতে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং কোন ব্যক্তি সেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে কোন সমাবেশ করে বা জনসংগম নিয়ে কোন দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টি করে সেই ক্ষেত্রে তার শাস্তি কি হবে? সেক্ষেত্রে উক্ত অপরাধী যে কিনা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে, তাকে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন এবং দুই বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম দণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন।

এতক্ষণ পর্যন্ত সব ইতিবাচক মনে হলেও ১৪৪ ধারা তৈরির পিছনের ইতিহাস কিন্তু আমাদেরকে বিভিন্ন নেতিবাচক গল্প শোনাবে। বলা হয়ে থাকে যে, বিরোধী মত দমন করার উদ্দেশ্যেই ১৮৯৮ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই ১৪৪ ধারা প্রণয়ন করেছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কেউ কোন সভা সমাবেশ বা মিছিল করতে চাইলেই যেন ১৪৪ ধারা জারি করে সেটি দমন করা যায় সে জন্যই নাকি এই ধারাটি প্রণয়ন করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ আইন প্রণেতারা।
১৪৪ ধারা কিন্তু আমাদের ইতিহাসেরও একটি অংশ; ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর সহ আরো অনেকেই রাস্তায় নেমেছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই দাবিতে। ঐদিনও কিন্তু তাদের দাবি মেনে না নিতে তথা ছাত্রদের আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। কিন্তু সেই সময় সেই ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল করার কারণে তখনকার পুলিশ গুলি চালিয়েছিল নির্বিচারে, যার ফলশ্রুতিতে শহীদ হয়েছিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর সহ আরো অনেকেই। আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছি, বাংলা ভাষায় লিখছি, আপনিও এই অনুচ্ছেদটি বাংলা ভাষায় পড়ছেন; যার জন্য কোন একদিন আন্দোলন হয়েছিল, জারি হয়েছিল ১৪৪ ধারা, শহিদ হয়েছিলেন অনেকেই আর আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.