জমি কেনার সময় কি করবেন

জমি ক্রয়ের আগে ক্রেতার করণীয়ঃ পর্ব ৩

জমি-জমার আইন দেওয়ানি আইন

আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে অনেক মানুষ আছেন যারা তারা কয়েক পুরুষ যাবত একই বাড়িতে আছেন। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত একই বাড়িতে, একই জমিতে আছেন। এটা আমার আপনার অনেকেরই গ্রামের বাড়ির একই অবস্থা। খুব কম সংখ্যক লোক হয়ত বিক্রি করেছে, না হলে বেশিরভাগই পৈত্রিক জমি বিক্রি করেনি। আপনি এখনো খোঁজ নিয়ে দেখলে দেখতে পাবেন যে, বাহিরের নাল বা কৃষি জমি বিক্রি করলেও বসতবাড়ি বিক্রি করেনি এমন মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ঐ মানুষদেরকে যদি আপনি ওনাদের বাড়ির জায়গার দলিল দেখাতে বলেন, দেখবেন তাদের বেশিরভাগেই দলিল নেই। আবার অনেকেরই দলিল আছে, সেটা কেন আছে, সেই বিষয়ে একটু পরে আসছি। যাদের দলিল নেই, তাদের কেন নেই, সেই বিষয়ে আগে আলাপ করি।
ব্রিটিশ আমলে যখন প্রথম ভারতবর্ষের জমির রেকর্ড করা শুরু করে, তখন ঐ রেকর্ডটির নাম দেওয়া হয় সিএস রেকর্ড। খণ্ড খণ্ড করে এটি ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় জমির শ্রেণী, দখলদার, পরিমাণ, হিস্যা এসব নিয়ে রেকর্ড শুরু করে। তখন ধরুন আপনার দাদা বা দাদার বাবা কাউকে আপনাদের পৈত্রিক জমিতে পেলো। সেই অনুসারে আপনার দাদা বা দাদার বাবাকে দখলদার হিসেবে ঐ জমি রেকর্ড করিয়ে দিল। রেকর্ডের পরও আপনার দাদা বা দাদার বাবা ঐ জমি বিক্রি করেননি। তারপর পাকিস্তান আমলে আরএস/এসএ/পিএস/এমআরআর যেই রেকর্ডই হয়েছে বা যেই নামেই রেকর্ড হয়েছে, তখনও ধরুন আপনার বাবা বা দাদা বা দাদার বাবাকে ঐ জমিতে পেয়েছে এবং রেকর্ড করিয়ে গেছে দখলদার হিসেবে। এরপর সর্বশেষ এলো, বিএস রেকর্ড। বিএস রেকর্ডেও আপনাদেরকে দখলে পেলো এবং আপনাদেরকে দখলদার হিসেবে রেকর্ড করে গেলো। তাহলে সিএস রেকর্ড, আরএস/এসএ/পিএস/এমআরআর রেকর্ড এবং বিএস রেকর্ডে যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ মালিক হচ্ছেন, তাদের কোন দলিল না থাকাই স্বাভাবিক। এখন আপনি যদি এই ধরণের কারো কাছ থেকে জমি কিনতে যান, সেক্ষেত্রে আপনাকে দেখতে হবে ওনাদের রেকর্ড ঠিক আছে কিনা। রেকর্ড ঠিক আছে কিনা এটা জানতে হলে আপনাকে ওনাদের সিএস খতিয়ান, আরএস/এসএ/পিএস/এমআরআর খতিয়ান এবং বিএস খতিয়ান দেখতে হবে। তবে, এখন বিএস ফাইনাল দিয়ে জমিজমা ক্রয় বিক্রয় করা যায় বলে, আপনি শুধু বিএস রেকর্ড তথা খতিয়ান দিয়েও জমি ক্রয় করতে পারেন। তবে, বিএস খতিয়ানে যেহেতু অনেক ভুল ভ্রান্তি হয়েছিল এবং এর জন্য এলএসটি (ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল)’তে মামলা হয়েছে এবং এখনো চলমান, সেহেতু আপনি নিজ দায়িত্বে ওনাদের সাবেক রেকর্ড গুলো চেক করে নিতে পারেন। এটা একদমই সহজ। বর্তমান যেই দাগের জায়গা ক্রয় করবেন, সেই দাগকে বলা হয় হাল দাগ। এই দাগের সাবেক দাগ কতো ছিল সেটা বের করবেন। সাবেক ঐ দাগের বিপরীতে কয়টি খতিয়ান হয়েছিল, সেটা বের করবেন। ঐসব খতিয়ানে আপনি এখন যার কাছ থেকে জমি ক্রয় করতে চাচ্ছেন, অর্থাৎ বিক্রেতা, তার নাম এবং হিস্যা আছে কিনা সে টা দেখবেন, যদি সবকিছু ঠিক থাকে তাহলে ক্রয় করতে পারেন। তবে খতিয়ান দেখে জমি কেনার সময় একটা ভুল অনেকেই অতীতে করেছেন, সেটি হচ্ছে হিস্যা না দেখে ক্রয় করা। খতিয়ানে জায়গাও আছে, দাগেও আছে, কিন্তু বিক্রেতার ততটুকু হিস্যা নাই। সেক্ষেত্রে আপনার উচিত হবে হিস্যা হিসেব করে তারপর ক্রয় করা।
আবার অনেকেরই দলিল আছে, সেটা কেন আছে, সেই বিষয়ে একটু পরে আসছি: রেকর্ড সূত্রে বা খতিয়ান সূত্রে আপনার দাদা যদি মালিক থাকে, দাদার মৃত্যুর পর আপনার বাবা চাচারা নিজেদের মধ্যে আপোষ বণ্টন দলিল বা বাটোয়ারা মামলার মাধ্যমে দলিল হলে সেই দলিলের মাধ্যমেও আপনি চাইলে জমি ক্রয় করতে পারেন কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও আপনাকে আপোষ বণ্টন বা বাটোয়ারা যেই খতিয়ানের ভিত্তিতে হয়েছে সেটি যাচাই বাছাই করে দেখতে হবে।
খতিয়ান সূত্রে মালিক হওয়ার ব্যক্তিদের কাছ থেকে জমি কেনার বিষয়ে আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, তাদের হিস্যা এবং তাদের বণ্টন ব্যবস্থা দেখে নেওয়া উচিত। একটা বাস্তব উদাহরণ দিয়েই বুঝানো যাক, আমরা দুই ভাই, আমাদের দুইজনের যৌথ খতিয়ানে ১০ কাঠার একটা জমি আছে। আমি আপনার কাছে বিক্রি করতে চাচ্ছি, খতিয়ান সূত্রে আমি বিক্রি করতে পারবো, আপনিও ক্রয় করতে পারবেন; কোন সমস্যা নাই। কিন্তু, জমিটির কোন সাইড আমি বিক্রি করবো বা কোন সাইড আপনি ক্রয় করবেন? এই বিষয় নিয়ে অনেক ঝামেলা তৈরি হয় কেননা খতিয়ানের যেহেতু হিস্যা/অংশ উল্লেখ থাকে কিন্তু চৌহুদ্দি উল্লেখ থাকে না, সেহেতু বিক্রির ক্ষেত্রে প্রথমে যে বিক্রি করে সে নিজ ইচ্ছে মত বিক্রি করে ফেলে সেহেতু পরের জন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি প্রথমজনের কাছ থেকে ক্রয় করেও দখলে যেতে ক্রেতার বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। দেখা যায়, প্রথম জনের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে আপনি দখলে যেতে গেলে আপনাকে দ্বিতীয়জন বাঁধা দিবে। তখন চৌহুদ্দি যতোই উল্লেখ থাকুক না কেন, মানুষ বিচার করতে গেলে কখনোই আপনার পক্ষ নিবে না। কেননা, চৌহুদ্দি নির্ধারণ হওয়ার আগে আপনি জমি ক্রয় করলেন কেন বরং সেটা নিয়ে মানুষ তথা সালিশদাররা আপনাকে দুষবে। তাই, চৌহুদ্দির বণ্টনের আগেও জমি কিনবেন না। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, জমি কিনে আপনি দখলে চলে গেছেন, দ্বিতীয় ভাই বা অংশীদার আপনাকে দখলে যেতে বাঁধা দিতে পারল না, কিন্তু আপনার ক্ষতি করার জন্য আপনার পাশে ঐ ব্যক্তির যে অংশ রয়েছে, সেটাকে কেটে পুকুর বানিয়ে ফেলবে যাতে আপনার অংশ থেকে মাটি নেমে যায়। মানুষ ক্ষতির পেলেই সেটা কাজে লাগাতে চাইবে, তাই আইনানুগ ভাবে সঠিক থাকতে হবে যাতে মানুষ ক্ষতি করার সুযোগ না পায় আপনার কাছ থেকে।

[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ পর্ব ১ ।| পর্ব  ২ | পর্ব  ৪ | পর্ব ৫ ।| পর্ব  ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ ]

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.