জমি কেনার সময় কি করবেন

জমি ক্রয়ের আগে ক্রেতার করণীয়ঃ পর্ব ৪

জমি-জমার আইন দেওয়ানি আইন

জমির দলিল এবং খতিয়ান দেখে তো জমি কীভাবে কিনতে হবে বা কি কি সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হল, এবার আসুন দখল নিয়ে আলোচনা করা যাক। দলিল, খতিয়ান এগুলো কিন্তু পুরোটাই কাগজপত্রের বিষয়, দখল হচ্ছে পুরোপুরি সরেজমিনে যে জমিটি কিনতে যাচ্ছেন সেটি। জমি ক্রয় কিন্তু এই দখলকে কেন্দ্র করেই। কেননা, একটা জমি দেখতে যতোটা অবস্থা সম্পন্ন, সেই জমির দাম ততো বেশি। গ্রামের জমির যে কাগজপত্র বা খতিয়ান, শহরের জমিরও সেই একই ধরণের দলিল, একই ধরণের খতিয়ান। কিন্তু, শুধু অবস্থার পরিবর্তনের কারণে জমির মূল্য আকাশ পাতাল। রাস্তার পাশের জমির মূল্য আর কয়েক জমির পরের জমির মূল্যের মধ্যে পার্থক্য হয় শুধুমাত্র জমির অবস্থানের উপর নির্ভর করে। তাই, দলিল, খতিয়ানের চেয়েও বেশি জরুরী কোন কোন ক্ষেত্রে জমির দখল। দখল ছাড়া জমির দলিল বা খতিয়ান নিয়ে বসে আছে এমন পাবলিকেরও অভাব নেই।
আপনি জায়গা কেনার আগে জমির দলিল বা খতিয়ান চেক তো করে নিবেন, কিন্তু জমির দখল সম্বন্ধে যদি ওয়াকিবহাল না থাকেন, তবে দেখবেন দলিল বা খতিয়ান ধুয়ে ধুয়ে পানি খেতে হবে। আপনি জানেন না হয়ত, টাকা দিয়ে জাল খতিয়ান বানানো সম্ভব, জাল দলিল বানানো সম্ভব। কিন্তু, দখল নিয়ে এসব জালিয়াতি চলে না। জমি বাড়ানো কমানো কাগজ কলমে সম্ভব হলেও দখলে সেটা সম্ভব নয়। হয়ত আপনার জায়গা আপনার পাশের জনের দখলে হাল্কা চলে যেতে পারে বা রাস্তার কাজে একটু ছেড়ে যেতে হতে পারে, কিন্তু জায়গা জায়গার জায়গাতেই থাকবে।
অনেক সময় দেখবেন ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে প্লট কেনা হয়, যার কাগজপত্র দেখে ঠিকই মনে হয়, কিন্তু জমির দখল দেখতে গেলে দেখা যায় যে, সেটা হয় পানির নীচে বা এখনো প্লট হিসেবে প্রস্তুত করা হয়নি। কিন্তু, তেমনি সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও জমি কিনতে গেলে জমির কাগজপত্র ঠিক থাকলেও জমির দখলে অনেক চিটিংবাজি করা হয়। একটি লোকের পাশাপাশি দুইটি জমি, একটা নিজের দখলে, আরেকটা অন্যের দখলে(দখল সংক্রান্ত ঝামেলা)। তখন বিক্রির সময় ক্রেতাকে দেখাবে যেটা নিজের দখলে আছে সেটা, কিন্তু বিক্রির পর ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিবে যেটা নিজ দখলে নেই সেটা। এই দখল বেদখলের বিষয়টা যদিও একটা অনেকেই খোঁজ খবর নিয়ে সচেতন হতে পারলেও একটা বিষয় এখনো অহরহ ঘটছে, সেটা হচ্ছে জমি দেখাবে রাস্তার পাশেরটা, কিন্তু পরে দেখা যাবে জমি বিক্রি হয়েছে রাস্তা থেকে এক জমি পরে। যে জমিতে যেতে হলে অন্যের জমির উপর দিয়ে যেতে হয়, সেই জমি শতাংশ প্রতি যে মূল্য দিয়ে ক্রয় করতে হয়, অনেক সময় দেখা যায় শুধুমাত্র রাস্তার জন্য সামনের জমির মালিককে কয়েক ফুটের রাস্তার জন্য কয়েক শতক জমির মূল্য দিতে হয়।
দখল সংক্রান্ত ঝামেলা এড়াতে আপনাকে জমি ক্রয়ের আগে আশেপাশের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে দেখে নিতে হবে যে বিক্রেতা আসলে ঐ জমির মালিক কিনা, জমির সীমানা চারপাশে কতটুকু?
সরকারি জরিপ অনুসারে জমিকে চিহ্নিত করা হয় দাগ নাম্বার দিয়ে। এই দাগ নাম্বার অনুসারেই জমির প্লট গুলো বিভক্ত। আপনি যেই দাগের জায়গা ক্রয় করতেছেন, সেই দাগ নাম্বারটি ঠিক কোথায় অবস্থান করতেছে সেটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হলে আপনাকে বিএস রেকর্ডের ম্যাপ দেখতে হবে। ম্যাপে উক্ত দাগ নাম্বারের অবস্থান ঠিক কোথায় সেটা আপনি সহজেই চিহ্নিত করে ম্যাপ ধরে ধরে জায়গায় চলে যেতে পারবেন। তখন কেউ যদি আপনাকে একটি জমির কথা বলে অন্য জমিও বুঝিয়ে দিতে চায়, আপনি সেই চিটিংবাজি ধরে ফেলতে পারবেন।
এমনও অনেক সময় দেখা যায়, দলিলে বা খতিয়ানে উল্লেখ আছে জমি শ্রেণী নাল, অর্থাৎ জমি, আপনি জমি হিসেব করেই টাকা দিলেন কিন্তু পরে দেখল নিতে গিয়ে দেখলেন যে জমি তো পুরো জমি নেই, পাশে বিশাল গর্ত করে পুকুরের ভিতর আপনার জমি ঢুঁকে গেছে। বিএস যখন রেকর্ড হয়, তখন যেসব জমি নাল তথা জমি ছিল, এখন অনেক জমিই ভিটি তথা বাড়ি যেমন হয়ে গেছে, তেমনি অনেক নাল জমি ডোবা তথা পুকুরের মতো হয়ে গেছে। এজন্যই, আপনি শুধু কাগজপত্র দেখে জমি ক্রয় করলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এটা সঞ্চয়পত্র বা শেয়ার না যে, কাগজপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেই হবে, এটা বাস্তবতা সম্পৃক্ত বিষয়। প্রতিনিয়ত এটার ধরন পরিবর্তন হচ্ছে, তাই ম্যাপ হাতে জায়গায় দাঁড়িয়ে তারপর আপনি জায়গার মূল্য নির্ধারণ করবেন।
আরেকটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে, জমি কেনার সময় এজেন্টের মাধ্যমে কখনো জমি দেখতে যাবেন না, অবশ্যই জমির মালিককে নিয়ে যাবে। অনেক সময় জমির মালিক একই জমি একাধিকবার বিক্রি করার কারণে জমির মালিক নিজেকে নতুন ক্রেতাকে নিয়ে জমি দেখতে যায় না, এজেন্টকে দিয়ে জমি দেখাতে পাঠাবে, আমি অবশ্যই জমি দেখতে হলে জমির মালিককে নিয়ে যাবেন সাথে আশেপাশের কয়েকজনকেও জমি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করবেন। আর, এক দেখাতেই জমির দখল সম্বন্ধে আপনি সুনিশ্চিত হতে পারবেন না হয়ত, আপনি মালিকের অনুপস্থিতিতেও পারলে জায়গা সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিবেন। ছেলে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় গ্রাম অঞ্চলে মানুষ যেমন বেনামে বাড়ি ঘর দেখতে আসে, খোঁজ খবর নিতে আসে, তেমনি নিজের পরিচিতির বাহিরের জমি কিনতে গেলেও ভালোভাবে খোঁজ খবর নিতে হবে। দলিল, খতিয়ান আপনি ঘরে বসে চেক করতে পারলেও দখল একান্ত আপনাকে জমিতে যেতে হবে। ডেভেলপারদের কাছ থেকে জমি কিনতে গেলে এই বিষয়টা বেশি লক্ষ্য রাখতে হবে। ডেভেলপাররা অনেকসময় ফরোয়ার্ড সেলিং করে থাকে বলেই এই সমস্যা গুলো বেশি দেখা দেয়, ফলে কোম্পানির বেঁধে দেওয়া সময়ের পরও কোম্পানি নিজে জমি বুঝিয়ে দিতে পারে না। তাই, সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে টাকা দেওয়ার আগেই, টাকা দিয়ে পরে মাথা চাপড়ালেও কোন লাভ হবে না।

[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ পর্ব ১ ।| পর্ব  ২ | পর্ব ৩ ।| পর্ব ৫ ।| পর্ব  ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ ]

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.