জমি কেনার সময় কি করবেন

জমি ক্রয়ের আগে ক্রেতার করণীয়ঃ পর্ব ৫

জমি-জমার আইন দেওয়ানি আইন

একটা সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে ৫ শতকের একটা জায়গা কিনলেন ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করে। কিন্তু, বাড়ি করার জন্য যখন প্ল্যান পাস করিয়ে এনে বাড়ির কাজ ধরতে গেলেন তখন দেখলেন জায়গা আছে, ৪.৫ (সাড়ে চার) শতক। চারপাশে বাড়ি উঠায় সবাই একটু একটু করে ছাপতে ছাপতে আপনার আধা শতক জায়গা ছেপে দিয়েছে। এখন এই আধা শতক জায়গার দাম কত পড়ল?- ৫ লক্ষ টাকা। এই টাকা কি ফেরত পাবেন আপনি জীবনেও?
পঞ্চম পর্বে এসে আমরা আলোচনা করবো জমি ক্রয়ের পূর্বে জমি মেপে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে। আপনি বাজারে গিয়ে এক বস্তা চাল কিনলেন, টাকাও পরিশোধ করলেন, রসিদও নিলেন, কিন্তু বাড়ি এসে আপনার গিন্নী বলল চাল ২৫ কেজি চালের বস্তায় যে ড্রাম আগে কানায় কানায় পূর্ণ হতো, সেই ড্রাম তো আজ চার আঙুল নীচেই রয়ে গেল। আপনি তখন কি আর দোকানে গিয়ে চ্যাঁচামেচি করে কিছু করতে পারবেন নাকি কেনার সময়ই যদি বস্তাটা একটু ওজন করে দিন তো, তাহলেই কি লেটা ছুঁকে যেত না?
জমির বেলাতেও তাই, রেজিস্ট্রির আগে যদি আপনি আপনার ক্রয় কৃত জমিটি একবার মেপে দেখতেন, তাহলে ক্রয়ের পরে আর কোন ঝামেলা পোহাতে হতো না। জমি ক্রয়ের আগে যদি দেখতে পান যে জমিতে কাগজের তুলনায় কিছু অংশ কম আছে, তাহলে সেই পরিমাণ টাকা আপনি কম দিয়ে জমিটি ক্রয় করতে পারবেন।
একটি জমি যখন আপনি ক্রয় করবেন বলে মন স্থির করেন, তখন আপনার উচিত হচ্ছে প্রথমে জমির কাগজপত্র গুলো যাচাই বাছাই করা। যেমন, দলিল, খতিয়ান এগুলো। এরপর সরেজমিনে এসে জমির অবস্থান তথা দখল দেখার পর আপনার দায়িত্ব হচ্ছে, বিক্রেতা জমির যে পরিমাণ বলছে সেটা আসলেই আছে কিনা। কেননা, বিক্রেতার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অনেকসময়ই জমি কাগজপত্রে যা থাকে, সরেজমিনে তা থাকে না। সেগুলো অনেক কারণেই হতে, সেসব নিয়ে লিখতে গেলে আরেকটা আর্টিকেল হয়ে যাবে। তবে, জমি কমে যাওয়ার কারণগুলো নিয়েও আরেকটা আর্টিকেল লিখবো যাতে জনসাধারণের বুঝতে সুবিধা হয়।
আচ্ছা, এখন আসুন জায়গা কম পেলে বা বেশি পেলে কি করবেন?- বেশি পেলে জমির মালিক আপনার কাছে বেশিই বিক্রি করতে চাইবে, কিন্তু আপনি তা করবেন না, কেননা কাগজে বেশি নেই। সুতরাং, নামজারি বা খারিজে আপনি বেশি খারিজ করাতে পারবেন না। সুতরাং, যা কাগজে আছে, তাই কিনুন আর অবশিষ্ট যেটা থাকবে সেটা ভোগ দখল করতে পারলে করবেন না পারলে সেটার প্রতি লোভ দেখানোর দরকার নেই। কেন জমি রেকর্ডের চেয়েও সরেজমিনে বাড়ে বা কমে সেটা নিয়ে অন্যদিন আরেকটা আর্টিকেলে লিখবো।
মাপজোক করে জমি কিনলে সুবিধা হচ্ছে, আপনি মেপে তারপর খুঁটি দিয়ে দিতে পারবেন। ফলে জমির চৌহদ্দি আর এদিক ওদিক সরতে পারবে না। সবসময় কিন্তু একটি দাগে জমি ঠিক যতটুকু ঠিক ততটুকুই বিক্রি করা হয় না,এক দাগে ২০ শতাংশ জায়গা আছে, সেখান থেকে হয়ত ৪/৫ শতাংশ জমি বিক্রি করা হবে। আপনি ঠিক কোন দিকে এবং কি ধরণের স্কয়ার করে জমি ক্রয় করছেন, সেটা জমি কেনার আগেই ঠিক করে নিন। একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে বলি তাহলে, ৫ ভাইয়ের সম্পত্তি একসাথে ১০ শতাংশ। তাদের মাঝে সম্পত্তিটি এজমালি হিসেবে অর্থাৎ যৌথ হিসেবে রয়েছে। কে কোন দিক দিয়ে পাবে বা নিবে, সেটা এখনো নির্ধারিত হয়নি। এমন সময় যেকোনো এক ভাইয়ের নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়েছে বিধায় সে তার অংশ অর্থাৎ ২ শতাংশ জমি বিক্রির প্রস্তাব দেয়। তার ভাইয়েরা কেউ নিতে না চাইলে পরে বাহির থেকে একজন ক্রেতা ঠিক করে তার কাছে বিক্রির ব্যাপারে কথাবার্তা ঠিক করা হয়। এমতাবস্থায়, ক্রেতা দলিল ও খতিয়ান চেক করে দেখল যে এখানে ১০ শতাংশ জমির মালিক আসলেই এরা ৫ ভাই। আবার তাদের সকলের অংশও সমান। দখলও ঠিক আছে। তাহলে এক ভাই ২ শতাংশ জমি বিক্রি করতেই পারে। সেই হিসেবে সে টাকা পয়সা পরিশোধ করে এবং জমি বিক্রি রেজিস্ট্রিও সম্পন্ন করে। জমি বিক্রি সম্পন্ন হওয়ার পর যখন সে জমির দখল বুঝে নিতে গেল, তখন পড়ল বিপত্তিতে। বিপত্তির কারণ হচ্ছে, জমি ক্রয়ের আগে হাতে মুখে যেভাবে পেরেছে সেইভাবে বিক্রেতা বুঝানোর চেষ্টা করে যে বিক্রেতা যেভাবে চায় ঐভাবেই ২ শতাংশ জমি তাকে স্কয়ার করে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু, বাস্তবে যখন জমি বুঝিয়ে দিতে গেল, তখন তাকে ১০ ফুট প্রস্থ আর ৮৭/৮৮ ফুট দৈর্ঘ্যের একটা লম্বা কবরস্থান টাইপের জমি বুঝিয়ে দিয়েছে। জমিটি যেহেতু রাস্তার পাশে, তাকে প্রথমে রাস্তার পাশে স্কয়ার করে দেওয়া হবে বলে কথা দেওয়া হয়, এরপর জমি বিক্রি সম্পন্ন হলে তাকে রাস্তার পাশে না দিয়ে ভেতরের দিকে স্কয়ার করে দেওয়ার কথা বলে। যেহেতু রাস্তা থেকে ঐ ব্যক্তিকে জমিতে পৌঁছাতে হবে, তাই সে বলে না যেভাবেই হোক রাস্তার পাশে মুখপাত থাকতে হবে, এখন তাকে রাস্তা থেকে ১০ ফুট প্রস্থ আর ৮৭/৮৮ ফুট দৈর্ঘ্যের একটা লম্বা জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এখানে একটা দুই শাটারের দোকান করাও মুশকিল হয়ে যাবে। এখন ক্রেতা জমি কিনেও সেটাকে কোন কাজে লাগাতে পারছে না, পারছে না বিক্রি করতেও। তাই, অধীর আগ্রহে বসে আছে বাকী ৪ ভাইয়ের কেউ তার কাছে আরও একটু জায়গা বিক্রি করে কিনা। এমন পরিস্থিতিতে পড়ার চেয়ে জমি ক্রয়ের আগেই জমি মেপে জমির চৌহদ্দি নির্ধারণ করে নেওয়াই শ্রেয়।

[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ পর্ব ১ ।| পর্ব  ২ | পর্ব ৩ ।| পর্ব  ৪ | পর্ব  ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ ]

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.