সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৯ অনুযায়ী, যদি কেউ অনলাইনে, অর্থাৎ ওয়েবসাইট বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে Penal Code ১৮৬০-এর ধারা ৪৯৯ অনুযায়ী মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করে, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে অনধিক ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে। এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, কি করলে Penal Code ১৮৬০-এর ধারা ৪৯৯ অনুযায়ী মানহানি হবে? তো চলুন আমরা জানার চেষ্টা করি, Penal Code ১৮৬০-এর ধারা ৪৯৯ অনুযায়ী মানহানি কাকে বলে এবং কোনগুলোকে আমরা মানহানি বলে অভিহিত করবো।
মানহানি (Defamation) কী?
Penal Code ১৮৬০-এর ধারা ৪৯৯ অনুসারে, যদি কেউ কথা বলে, লেখার মাধ্যমে, কোনো চিহ্ন বা দৃশ্যমান প্রতীক ব্যবহার করে অন্য কারো সম্পর্কে এমন কিছু বলে যা সেই ব্যক্তির সুনাম ক্ষুণ্ন করে বা ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্য নিয়ে বলে, তাহলে সেটিকে মানহানি বলা হয়। এর উদ্দেশ্য যদি সেই ব্যক্তির মানহানি করা হয় বা যদি বলা ব্যক্তির ধারণা থাকে যে তার এই কথা অন্যের চোখে সেই ব্যক্তির সুনাম নষ্ট করবে, তখন এটিকে মানহানিকর বলে ধরা হবে।
ব্যাখ্যা ১: মৃত ব্যক্তির সম্মানহানিঃ যদি কোনো মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে এমন কিছু বলা হয় যা জীবিত অবস্থায় তার সুনাম ক্ষুণ্ন করতো এবং এটি তার পরিবারের বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের অনুভূতিতে আঘাত করে, সেটিও মানহানি হিসেবে গণ্য হবে।
ব্যাখ্যা ২: প্রতিষ্ঠানের মানহানিঃ একটি কোম্পানি, সমিতি বা কোনো গোষ্ঠীর সম্পর্কে মানহানিকর মন্তব্য করাও মানহানি হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ, শুধু ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীকেও এর আওতায় আনা হয়েছে।
ব্যাখ্যা ৩: বিকল্প বা ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যঃ যদি কোনো মন্তব্য বিকল্পভাবে বা ব্যঙ্গাত্মকভাবে করা হয়, তবে সেটিও মানহানি হতে পারে। যেমন, কোনো কথা সরাসরি না বলে এমনভাবে বলা হয় যাতে মানহানির ইঙ্গিত দেওয়া হয়, সেটিও অপরাধ।
ব্যাখ্যা ৪: সম্মানহানির প্রভাবঃ কোনো ব্যক্তির মানহানি তখনই হবে, যখন সেই মন্তব্য অন্যদের চোখে সেই ব্যক্তির নৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক চরিত্রকে হেয় প্রতিপন্ন করবে, তার সামাজিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করবে, বা তাকে এমন অবস্থায় ফেলে যে তার শরীর বা চরিত্রকে লজ্জাজনক বলে বিবেচিত হয়।
এই থেকে আমরা বুঝলাম যে, কেউ আপনার সম্পর্কে মিথ্যা কিছু বলছে বা এমন কিছু প্রকাশ করছে যা আপনার সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে, তাহলে এটি আইনের অধীনে একটি অপরাধ বলে গণ্য হবে। তবে এটি তখনই প্রযোজ্য হবে যখন সেই মন্তব্য বা কাজের মূল উদ্দেশ্য হবে আপনার সুনাম নষ্ট করা। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ আপনাকে সরাসরি চোর বলে বা এমন একটি ছবি আঁকে যা দেখে অন্যরা মনে করবে আপনি চুরি করেছেন, তাহলে এটি আপনার মানহানি। কিন্তু, যদি সেই ব্যক্তি প্রমাণ করতে পারে যে তার বক্তব্য সঠিক ছিল বা কোনো বৈধ কারণ ছিল, তবে সেটি ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৯ এবং দণ্ডবিধির ১৮৬০-এর ধারা ৪৯৯-কে একত্রিত করে মানহানির বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, অনলাইনে বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মানহানি করার ঘটনাগুলো আগের থেকে আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে। বর্তমান যুগে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, অনলাইন পত্রিকা, ওয়েবসাইট এবং টিভির মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারের ফলে অনেক দ্রুত এবং বড় পরিসরে মানহানিকর তথ্য ছড়ানো সম্ভব হচ্ছে।
অনলাইনে মানহানি কীভাবে ঘটতে পারে?
অনলাইনে যে কোনো প্ল্যাটফর্মে যদি এমন কোনো মন্তব্য, ছবি, ভিডিও বা তথ্য প্রকাশ করা হয়, যা কারো ব্যক্তিগত সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে, তাহলে সেটিকে মানহানি হিসেবে গণ্য করা হয়। দণ্ডবিধির ধারা ৪৯৯ অনুযায়ী, যেকোনো ব্যক্তি যদি অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে মানহানিকর মন্তব্য বা উপস্থাপন করে এবং তা অন্যের চোখে তার সম্মান বা সুনাম নষ্ট করে, সেটি মানহানি হবে। সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ এই প্রক্রিয়াকে আরও সুস্পষ্টভাবে অনলাইনের ক্ষেত্রে বিবেচনা করেছে এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এর শাস্তির বিধান করেছে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা কয়েকটি মূল প্ল্যাটফর্মে মানহানির ঘটনা বিশ্লেষণ করতে পারিঃ
১। ফেসবুকে মানহানিঃ ফেসবুক এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর একটি। এই প্ল্যাটফর্মে মানহানির ঘটনা ঘটতে পারে নিম্নোক্তভাবে:
– কেউ যদি ফেসবুকে কোনো পোস্ট করে যেখানে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোনো ব্যক্তির সম্পর্কে মানহানিকর মন্তব্য করা হয়।
– ফেসবুক লাইভে কোনো ব্যক্তির চরিত্র বা পেশাগত অবস্থানকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়।
– কারো ব্যক্তিগত ছবি বিকৃত করে অথবা বিভ্রান্তিকর তথ্য সহকারে প্রকাশ করা হয়, যা অন্যদের চোখে সেই ব্যক্তির সুনাম নষ্ট করে।
২। ইউটিউবে মানহানিঃ
– ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে মিথ্যা খবর বা অপপ্রচার চালানো হলে এবং এটি কারো সুনামের ক্ষতি করে, সেটিও মানহানি হিসেবে বিবেচিত হবে।
– ইউটিউব ভিডিওতে কারো বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ তুলে ধরা বা ভিডিওতে ব্যঙ্গাত্মকভাবে কারো ব্যক্তিত্বকে ছোট করা।
৩। টিকটকে মানহানিঃ
– টিকটকে ভাইরাল ভিডিওর মাধ্যমে কাউকে ছোট করার চেষ্টা করা হলে, বা মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হলে সেটি মানহানির অন্তর্ভুক্ত হবে।
– কোনো ব্যঙ্গাত্মক বা বিকৃত ভিডিও তৈরি করে, তা দিয়ে কোনো ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করা হলে তা মানহানি বলে ধরা হবে।
৪। হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইমোতে মানহানিঃ
– হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমো গ্রুপে কোনো মিথ্যা সংবাদ বা গুজব ছড়ালে, যা কারো সম্মান নষ্ট করতে পারে, সেটি মানহানি হিসেবে বিবেচিত হবে।
– কারো ব্যক্তিগত ভিডিও বা ছবি শেয়ার করে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা এবং তা গ্রুপ বা ব্যক্তিগত চ্যাটে ছড়ানো হলে সেটিও মানহানি হবে।
৫। ওয়েবসাইট এবং অনলাইন পত্রিকাঃ
– কোনো অনলাইন নিউজ পোর্টালে ভিত্তিহীন খবর বা তথ্য প্রকাশ করে কারো সম্মান নষ্ট করার চেষ্টা করা হলে সেটি মানহানি হবে।
– অনলাইনে লেখা এমন কোনো নিবন্ধ যেখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারো বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হয়।
৬। অনলাইন টিভিঃ
– অনলাইন টিভি শো বা টকশোতে কোনো ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার করে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা বা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা মানহানির শামিল।
যদি আপনার বিরুদ্ধে ফেসবুক বা অন্য কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয় যা আপনার ব্যক্তিগত সুনাম বা পেশাগত অবস্থান নষ্ট করে, তাহলে আপনি সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আদালতে নিয়ে আসা সম্ভব এবং অর্থদণ্ড বা শাস্তির মুখোমুখি করা যেতে পারে। ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )