পটভূমি ১: শীতের রাতে ব্যান্ডমিন্টন
শীতকাল এলেই গ্রামের ছেলেদের মধ্যে একটা নতুন উন্মাদনা দেখা যায়—ব্যান্ডমিন্টন খেলা। গ্রামের প্রতিটি মাঠেই শীতের সন্ধ্যাগুলো জমে ওঠে এই খেলায়। শহরের এক প্রান্তে ছিলো ছোট্ট একটি গ্রাম, যেখানে রাতের বেলায় ছেলেরা ব্যান্ডমিন্টন খেলতে ব্যস্ত। গ্রামের ছেলেদের কাছে একটাই সমস্যা—খেলার সময় পর্যাপ্ত আলোর অভাব। গ্রামের রাস্তার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা তেমন উন্নত না হওয়ায়, খেলা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
একদিন, গ্রামের এক বুদ্ধিমান ছেলে, রাকিব, একটা সমাধান খুঁজে পেলো। সে তার বন্ধুকে নিয়ে পাশের বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে সরাসরি লাইন টেনে নিলো। কোন বৈধ মিটার ছাড়াই বিদ্যুৎ নিয়ে মাঠের বাতি জ্বালানো হলো, আর ছেলেরা আনন্দে খেলা চালিয়ে যেতে লাগলো। রাকিব ভেবেছিলো, এটাতো এমন কিছু গুরুতর বিষয় নয়—বিদ্যুৎ নিলাম, আর একটু আলোর ব্যবস্থা করলাম। তবে এই কাজটা বিদ্যুৎ চুরির চরম উদাহরণ ছিল।
খেলার মজা চলছিল, কিন্তু অল্প কিছুদিন পর বিদ্যুৎ বিভাগের লোকেরা সেই গ্রামের নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে নজরদারি শুরু করে। তারা খুঁজে পায় যে কোথাও বৈধভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ না করে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। রাকিবের দলের খেলা থেমে গেলো, আর তারা বড় ধরনের জরিমানা এবং শাস্তির সম্মুখীন হলো। এই গল্প আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয়—খেলাধুলার মতো আনন্দের জন্যও কখনোই অবৈধ পথে কিছু করা উচিত নয়। এই সামান্য চুরির কারণে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তি পেতে হলো, যা তারা ভাবতেও পারেনি।
পটভূমি ২: ব্যাটারি চার্জিং গ্যারেজের বিদ্যুৎ চুরি
কয়েকটি অটো রিক্সার মালিকদের ব্যাটারি চার্জ করতে বেশ অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। শহরের এক কোণে, রুহুল আমিন নামে একজন রিক্সা মালিক তার গ্যারেজে বেশ কয়েকটি অটো রিক্সা রাতে রাখার এবং চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তবে, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় তার ব্যাটারি চার্জিংয়ের খরচ বেশ বেড়ে গিয়েছিলো। একদিন রুহুল সিদ্ধান্ত নিলো, অন্যদের মতো আমিও কেনো বৈধ পথে বিদ্যুৎ বিল দেবো? সে পাশের বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে সরাসরি লাইন টেনে গ্যারেজের ব্যাটারি চার্জ করতে শুরু করলো।
কয়েকদিন ধরে এই পদ্ধতিতে চললো সবকিছু। রুহুল খরচ কমাতে পেরেছিলো, আর তাই সে বেশ খুশি। কিন্তু একদিন বিদ্যুৎ বিভাগের এক ইন্সপেক্টর তার এলাকায় টহল দেওয়ার সময় রুহুলের গ্যারেজের অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি ধরে ফেললেন। দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে জানা গেল, রুহুল দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ চুরি করে তার অটো রিক্সাগুলোর ব্যাটারি চার্জ করছিলো। ফলাফল, তাকে চুরিকৃত বিদ্যুতের দ্বিগুণ মূল্য পরিশোধ করতে হলো, সঙ্গে শাস্তি হিসেবে বেশ বড় অঙ্কের জরিমানাও গুণতে হলো। রুহুলের এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে, সামান্য লাভের আশায় বড় ক্ষতি ডেকে আনা সহজ, যদি কেউ আইন ভঙ্গ করে।
পটভূমি ৩: ইলেকট্রনিক দোকানের অবৈধ সংযোগ
ইলিয়াস একজন ছোট্ট ইলেকট্রনিক দোকানের মালিক। তার দোকানে বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ অনেক বেশি ছিলো, কারণ সেখানে লাইট, ফ্যান এবং টিভি চালানোর প্রয়োজন হয়। বিদ্যুতের বিলও মাসের শেষে প্রচুর হয়ে যায়। একদিন ইলিয়াসের এক বন্ধু তাকে পরামর্শ দিলো—“কেন মিটারের বাইরে বিদ্যুৎ নিয়ে আসছো না? এতে অনেক টাকা বেঁচে যাবে।” ইলিয়াস ভাবল, এতে কোনো ক্ষতি নেই, বিদ্যুৎ ততোটা কমে যাবে না। সে এমনটাই করলো।
প্রথম কয়েকমাস ঠিকমতো চললেও, বিদ্যুৎ বিভাগের চেকিংয়ে তার এই কাজ ধরা পড়ে। ইলিয়াসকে বিশাল অঙ্কের জরিমানা করা হয় এবং তার দোকানের ব্যবসায় বড় ধরনের ধাক্কা আসে। এই গল্পগুলো থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, বিদ্যুৎ চুরির ক্ষেত্রে সামান্য লাভের আশা করলে, শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। আপনার নিজের বিবেক ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বৈধ উপায়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা উচিত।
বিবেক তো জাগিয়ে দিলাম, এবার আসুন আইনে কি আছে সেটা একটু জানার চেষ্টা করি।
বিদ্যুৎ চুরি বলতে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার বা গ্রহণ করা বুঝায়, যা আমাদের দেশের বিদ্যুৎ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। বিদ্যুৎ আইন, ২০১৮ এর ধারা ২(১২) অনুসারে, “বিদ্যুৎ চুরি” বলতে অবৈধ পন্থায় বিদ্যুৎ সংযোগ গ্রহণ করে তা ভোগ করা বা ব্যবহার করা বোঝায়। এর অর্থ, বৈধ অনুমোদন বা মিটার ছাড়াই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা একপ্রকার চুরি।
বিদ্যুৎ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৩২(১) এর আলোকে, যদি কেউ বাসগৃহে বা ব্যক্তিগত কাজে বিদ্যুৎ চুরি করে, তার শাস্তি হতে পারে অনধিক ৩ বছর কারাদণ্ড অথবা চুরিকৃত বিদ্যুতের মূল্যের দ্বিগুণ অথবা ৫০,০০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় শাস্তি। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি যদি তার বাসায় মিটার ছাড়াই বিদ্যুৎ সংযোগ নেয় এবং সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, তা সরাসরি বিদ্যুৎ চুরির শামিল হবে।
আবার ধরুন, মিরপুরের একটি বাসায় মিটার আছে, কিন্তু কিছু ব্যক্তি তাদের ঘরের জন্য আলাদা একটি লাইন নিয়ে মিটারের বাইরে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। এই কাজটি আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎ চুরি এবং তাদের উপর উল্লিখিত শাস্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বিদ্যুৎ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৩২(২) এর মতে, যদি কোন ব্যক্তি শিল্প বা বাণিজ্যিক কাজে বিদ্যুৎ চুরি করে, তার শাস্তি হতে পারে অনধিক ৩ বছর কারাদণ্ড অথবা চুরিকৃত বিদ্যুতের মূল্যের দ্বিগুণ অথবা ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি বেকারি মিটার ব্যবহারের বাইরে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর ফলে, সরকার এবং বিদ্যুৎ বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ তারা সেই বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য কোনো মূল্য প্রদান করছে না। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ওই বেকারির মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
এই ধরনের অজস্র উদাহরণ আমি আপনি ইতিমধ্যে জানি। বিদ্যুৎ চুরির ফলে ব্যক্তিগতভাবে আপনি তাৎক্ষণিক সুবিধা পেতে পারেন, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রথমত, এর ফলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং অনেক সময় সঠিক ব্যবহারকারীরা বিদ্যুৎ সঙ্কটে পড়ে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ চুরি এমন একটি অপরাধ যা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, কারণ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ সেই ক্ষতির মূল্য দিতে বাধ্য হয়।
আইনজীবী হিসেবে আমার পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণকে পরামর্শ হলো, বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈধ উপায় অবলম্বন করা উচিত। বৈধ সংযোগ ছাড়া বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে আপনি আইনের আওতায় শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন, যা আপনার ব্যক্তিগত জীবন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য সকলকে অনুরোধ করা হচ্ছে, বৈধ পথে বিদ্যুৎ ব্যবহার করুন এবং বিদ্যুৎ চুরি থেকে বিরত থাকুন।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )