মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ৩ ধারায় মানব পাচারের সংজ্ঞা এবং কিভাবে মানব পাচার হয় সেই সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী, ‘মানব পাচার’ বলতে বোঝানো হয় যখন একজন ব্যক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে শোষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এই শোষণ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন যৌন শোষণ, শ্রম শোষণ, অথবা অন্য কোন শোষণমূলক আচরণ। মানব পাচারের প্রধান তিনটি উপায় এই ধারা অনুযায়ী বর্ণনা করা হয়েছেঃ
১। ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করেঃ যখন কাউকে শোষণ করার উদ্দেশ্যে তাকে ভয় দেখিয়ে বা শারীরিক বলপ্রয়োগ করে পাচার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন একজন ব্যক্তিকে হুমকি দিয়ে বা মারধর করে বলা হচ্ছে, ‘তোমাকে কাজ করতে হবে, নাহলে তোমার পরিবারের ক্ষতি হবে’। এইভাবে কাউকে ভয় দেখিয়ে বা জোর করে কাজ করানো বা শোষণ করা হলে তা মানব পাচারের মধ্যে পড়ে।
২। প্রতারণা বা অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়েঃ কোনো ব্যক্তির আর্থিক, সামাজিক বা পরিবেশগত অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে তাকে শোষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করাও মানব পাচার। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো গরিব পরিবারকে চাকরির লোভ দেখিয়ে তাদের সন্তানকে বিদেশে পাঠানো হয় এবং সেখানে গিয়ে সে শোষণের শিকার হয়, তাহলে সেটিও মানব পাচারের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ, তাদের অসহায় অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে শোষণ করা।
৩। অর্থ বা সুবিধা বিনিময় করেঃ কিছু ক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তিকে শোষণের উদ্দেশ্যে অন্য ব্যক্তির সঙ্গে অর্থ বা সুবিধা বিনিময় করে নেওয়া হয়। যেমন, যদি কোনো ব্যক্তি নিজের অধীনে থাকা একজনকে টাকার বিনিময়ে অন্য কারো হাতে তুলে দেয় শোষণের উদ্দেশ্যে, সেটি মানব পাচার হিসেবে গণ্য হবে।
উপরোক্ত উপায়গুলো ব্যবহার করে যদি কাউকে বাংলাদেশে বা বাংলাদেশের বাইরে যৌন শোষণ, শ্রম শোষণ, বা অন্য যেকোনো শোষণের উদ্দেশ্যে বিক্রি, ক্রয়, স্থানান্তর, আটক, লুকিয়ে রাখা বা আশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে তা মানব পাচার বলে গণ্য হবে।
শিশু পাচারের ক্ষেত্রে ভিন্নতাঃ মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ধারা ৩(২) এ বলা হয়েছে, যখন পাচারের শিকার একজন শিশু হয়, তখন উপায়গুলো (যেমন: ভয়ভীতি, প্রতারণা ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা বিবেচ্য নয়। অর্থাৎ, একজন শিশুকে যেকোনোভাবে শোষণের উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রণ করা হলে, সেটি মানব পাচার হিসেবে বিবেচিত হবে, যদিও সেখানে উপরের তিনটি মাধ্যম অনুসরণ না করা হয়। যেমন, একটি পরিবারের বাবা-মা গরিব হওয়ায় তারা তাদের ১২ বছর বয়সী মেয়েকে কাজের জন্য শহরে পাঠান। একজন ব্যক্তি তাদের মেয়েকে ভালো চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু পরে তাকে বিভিন্ন জায়গায় শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে, মেয়েটির উপর তার আর্থিক অসহায়ত্বকে কাজে লাগানো হয়েছে এবং তাকে শোষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে, যা মানব পাচার হিসেবে গণ্য হবে। এই ধারা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, যেকোনোভাবে কাউকে শোষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হলে তা মানব পাচার হিসেবে বিবেচিত হবে।
মানব পাচার অপরাধের জন্য শাস্তি এবং দণ্ডঃ মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ধারা ৩ এ যে সমস্ত কার্যক্রমকে মানব পাচার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে (যেমন ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রতারণা, অর্থ বা সুবিধা বিনিময়, ইত্যাদি), সেই কার্যক্রম যদি কোন ব্যক্তি সংঘটিত করেন, তা মানব পাচার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ, কেউ যদি কাউকে শোষণের উদ্দেশ্যে বিক্রি, স্থানান্তর, আটক, লুকিয়ে রাখা অথবা আশ্রয় দেওয়ার মতো কাজ করেন, তাহলে তিনি আইনতভাবে মানব পাচারকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি গ্রামের একজন দরিদ্র মানুষকে বলে যে তিনি তার মেয়েকে বিদেশে চাকরির জন্য পাঠাবেন। কিন্তু আসলে তিনি মেয়েটিকে বিদেশে যৌন শোষণের জন্য বিক্রি করেন। এ ক্ষেত্রে, তিনি ধারা ৩ এর আওতায় মানব পাচারের অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। একইভাবে, যদি কেউ কাউকে ভয় দেখিয়ে বা বলপ্রয়োগ করে শ্রম শোষণে বাধ্য করে, তা-ও মানব পাচার হিসেবে গণ্য হবে।
যে ব্যক্তি মানব পাচার অপরাধে অভিযুক্ত হবেন, তার জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ৬ ধারা অনুসারে, মানব পাচারকারী ব্যক্তি নিম্নলিখিত শাস্তির সম্মুখীন হবেনঃ
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডঃ সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
সর্বনিম্ন ৫ বছরের কারাদণ্ডঃ শাস্তির ন্যূনতম সীমা হলো ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, যার মাধ্যমে অভিযুক্তকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
অর্থদণ্ডঃ অভিযুক্তকে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিতে হবে। এটি শাস্তির একটি অংশ, যা অভিযুক্তের আর্থিকভাবে শাস্তির প্রতিফলন করে।
মানব পাচার শুধুমাত্র ব্যক্তি বিশেষকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, এটি তার মানসিক এবং সামাজিক অবস্থানের উপরও গভীর প্রভাব ফেলে। এজন্য এই আইনের মাধ্যমে সরকার মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
আবার, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ১৫ ধারা মিথ্যা মামলা দায়ের এবং আইনের অপব্যবহার সম্পর্কিত শাস্তি ও আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার বন্ধ করার বিষয়ে কথা বলে।
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ধারা ১৫(১)’তে স্পষ্টভাবে বলে যে, কোন ব্যক্তি যদি অন্য কারো ক্ষতিসাধন বা হয়রানির উদ্দেশ্যে এই আইনের অধীনে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন, মিথ্যা অভিযোগ আনেন অথবা আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করেন, তা হলে তিনি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। এই আইনের অধীন মিথ্যা মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। সর্বনিম্ন শাস্তি হিসেবে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হবে। এছাড়া অভিযুক্তকে কমপক্ষে ২০,০০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। যেমন, ধরা যাক, একজন ব্যক্তি ব্যক্তিগত প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে একজন নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ আনেন, যেখানে তিনি জানেন যে অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। তার উদ্দেশ্য শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হয়রানি করা এবং তার সম্মানহানি করা। প্রমাণিত হলে, মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ধারা ১৫(১) অনুযায়ী মামলা হতে পারে এবং তিনি ২ থেকে ৫ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই ধরনের মিথ্যা মামলা দায়ের করা শুধুমাত্র অভিযোগকারীকে শাস্তির মুখোমুখি করে না, এটি আদালতের সময় এবং সম্পদের অপব্যবহারও করে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন, ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )