রাতের অন্ধকারে শান্ত ঘরে বসে আকাশ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল। তার চোখে উদ্বেগ আর অসহায়তার ছায়া। মাত্র কয়েক মাস আগে তার ছোট ভাই শামিমের বিয়ে হয়েছে। নতুন জীবন শুরু করার আনন্দে মেতে উঠেছিল সবাই। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই খুশির মাঝে নেমে এলো এক কালো মেঘের ছায়া। আকাশ মনে করতে পারল সেই দিনটার কথা। শামিম ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “ভাইয়া, আমার জিমেইল হ্যাক হয়ে গেছে। একজন আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে। কী করব আমি?” আকাশের বুকে ধক করে উঠেছিল। কিন্তু তখনও সে বুঝতে পারেনি যে এটা শুধু শুরু মাত্র। পরের দিন সকালে শামিম এসে সব খুলে বলল। হ্যাকার তার বউ মীরার কিছু ব্যক্তিগত ছবি হাতে পেয়েছে। এখন সে ব্ল্যাকমেইল করছে। আকাশের রাগে গা জ্বলে উঠল। কীভাবে কেউ এমন নীচ কাজ করতে পারে?
দিন যায়, সপ্তাহ যায়। হ্যাকারের দাবি বাড়তেই থাকে। প্রথমে ২০ হাজার, তারপর ৩০ হাজার, শেষে ৫০ হাজার টাকা। শামিম আর মীরা ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে। তাদের নতুন জীবনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। একদিন রাতে আকাশ শামিমের ফোন চেক করল। সেখানে সে পেল হ্যাকারের নাম আর ঠিকানা। তার মনে একটা পরিকল্পনা আঁকা শুরু হলো। কিন্তু সেটা কতটা নৈতিক হবে? আইনের চোখে তা কি ঠিক হবে?
আকাশ দ্বিধায় পড়ল। একদিকে তার ভাইয়ের সুখী পরিবার, অন্যদিকে আইনের শাসন। সে কি নিজের হাতে বিচার করবে? নাকি পুলিশের শরণাপন্ন হবে? কিন্তু পুলিশের কাছে গেলে কি মীরার ছবিগুলো প্রকাশ হয়ে যাবে না?
রাতের পর রাত ঘুম আসে না আকাশের চোখে। সে ভাবে, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। তার মনে হয় যেন সে একটা থ্রিলার মুভির নায়ক, যাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু এটা কোনো সিনেমা নয়, এটা বাস্তব জীবন।
শেষ পর্যন্ত আকাশ একটা সিদ্ধান্তে এলো। সে মনে মনে বলল, “আমি আমার ভাইকে রক্ষা করব, যে কোনো মূল্যে।” তার চোখে জ্বলে উঠল দৃঢ়তার আগুন। সে জানে, পথটা সহজ হবে না। কিন্তু সে পিছপা হবে না। আকাশ উঠে দাঁড়াল। সে জানে, আগামীকাল থেকে তার জীবন বদলে যাবে। কিন্তু সে প্রস্তুত। তার ভাইয়ের হাসি ফিরিয়ে আনার জন্য, মীরার সম্মান রক্ষার জন্য, সে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। রাতের অন্ধকারে আকাশের চোখে জ্বলে উঠল একটা নতুন আলো। সে জানে, এটা শুধু শুরু। আসল লড়াই এখনো বাকি…
উপরের নামগুলো কাল্পনিক কিন্তু এমন ঘটনা অহরহ ঘটে যাচ্ছে আমাদের সমাজে। কেউ হয়ত আপনজনের সাথে শেয়ার করে কিছুটা হাল্কা হতে পারছে, বাকিদের অবস্থা ততটা শুভকর নয়। অনেকেই আত্নহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। কেউবা নীরবে টাকা দিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কেউবা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হ্যাকারকে হন্নে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। খুঁজে পেলে মেরে ফেলছে। এভাবেই চলছে একেকজনের জীবন। কিন্তু, এখানে আইন নিজের হাতে না তুলে বা ব্ল্যাকমেইলের শিকার না হয়ে আইনের আশ্রয় নিলেই সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। আপনি ভাবছেন আপনার বা আপনার স্ত্রী বা প্রেমিকা বা কাছের কারো সম্মানহানি হবে যদি আইনের আশ্রয় নিতে যান, কিন্তু জেনে রাখুন ঐ অপরাধী সমাজের চোখে একজন নিচু শ্রেণীর লোক হিসেবে সারাজীবনের জন্য চিহ্নিত হবে। তাই, কখনো নিজেকে নিজে ধিক্কার না দিয়ে, আইনের আশ্রয় নিন। আর, যথাসম্ভব ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো ধারন না করাই ভালো যদি না আপনি সেগুলো সুরক্ষিত রাখতেই না পারেন।
তো চলুন জানার চেষ্টা করি, আপনি আইনের আশ্রয় নিলে অপরাধীর কি কি শাস্তি হতে পারে?
সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ৩২ ধারা সাইবার অপরাধের মধ্যে অন্যতম একটি গুরুতর অপরাধ, যা হ্যাকিং সম্পর্কিত। এই ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি হ্যাকিং-এর মতো কার্যকলাপে যুক্ত হন, তাহলে তা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
হ্যাকিং-এর সংজ্ঞাঃ
১। কম্পিউটার তথ্য ভাণ্ডারের কোনো তথ্য চুরি, বিনাশ, বাতিল, পরিবর্তন করা, কিংবা তথ্যের মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাস করা বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতিসাধন করা।
২। নিজ মালিকানা বা দখলবিহীন কম্পিউটার, সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করে সেগুলোর ক্ষতি করা।
শাস্তিঃ হ্যাকিং অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড। অভিযুক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী, উভয় শাস্তিই (কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড) একসঙ্গে প্রযোজ্য হতে পারে।
বিশ্লেষণঃ এই ধারা অত্যন্ত কার্যকরী, কারণ হ্যাকিং-এর মাধ্যমে একক ব্যক্তির ক্ষতি ছাড়াও বড় প্রতিষ্ঠান, সরকার এবং সামাজিক ব্যবস্থার ওপরও বড় ধরনের আঘাত আনা সম্ভব। হ্যাকিং এর অর্থ শুধুমাত্র তথ্য চুরি নয়, এটি তথ্যের পরিবর্তন, মুছে ফেলা বা নেটওয়ার্কের কার্যক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করাও অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে, ব্যক্তিগত, সরকারি বা ব্যবসায়িক তথ্য চুরি বা ধ্বংস করা যায়, যা অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
আবার, সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ২৯ ধারা সাইবার স্পেসে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। এখানে Penal Code, 1860 এর ৪৯৯ ধারা অনুযায়ী মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে তা উল্লেখ করা হয়েছে। দণ্ডবিধি অনুসারে মানহানি সম্বন্ধে জানতে নিচের আর্টিকেলটি পড়ে দেখতে পারেনঃ মানহানি মামলা কখন হয় এবং শাস্তি কি? – Article – Legal Fist
মানহানিঃ Penal Code, 1860 এর ৪৯৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির সম্মান ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা আক্রমণাত্মক তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে তা “মানহানি” হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মানহানিঃ এই আইন অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক বিন্যাসে যেমন ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া, ইমেল বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তবে তা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে।
শাস্তিঃ অভিযুক্ত ব্যক্তি এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে, তাকে সর্বোচ্চ ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে।
বিশ্লেষণঃ এই ধারা সাইবার স্পেসে মানহানি প্রতিরোধে বিশেষভাবে কার্যকর। ইন্টারনেটের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে মানহানি বা বদনাম করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে তথ্য ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সম্মান ও সুনামকে মারাত্মকভাবে আঘাত করতে পারে। এই আইনের মাধ্যমে সরকার ডিজিটাল মানহানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তাছাড়া, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ৮(২) ধারা মূলত পর্নোগ্রাফি ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তিগত মর্যাদার হানি করা, ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ বা অন্য সুবিধা আদায় করা, এবং মানসিক নির্যাতনের অপরাধের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ৮(২) ধারার মূল বিষয়বস্তুঃ
মর্যাদা হানিঃ যদি কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তিগত মর্যাদার ক্ষতি করে, তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ভয়ভীতি বা ব্ল্যাকমেইলিংঃ যদি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা আদায় করা হয়।
মানসিক নির্যাতনঃ কারো সম্মতি বা সম্মতির অভাবে ধারণকৃত পর্নোগ্রাফি ব্যবহার করে সেই ব্যক্তিকে মানসিকভাবে নির্যাতন করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
শাস্তিঃ এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হতে পারে। এছাড়াও, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ২,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে।
বিশ্লেষণঃ এই ধারা পর্নোগ্রাফি ব্যবহার করে অন্যের মানহানি, ব্ল্যাকমেইলিং, এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে পর্নোগ্রাফির অপব্যবহার করে অনেক ব্যক্তিকে সামাজিক ও মানসিকভাবে আঘাত করার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় ব্যক্তি সম্মতি ছাড়াই ধারণকৃত ভিডিও বা ছবি ব্যবহার করে তার ব্যক্তিগত মর্যাদা হানি করা হয় বা তাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়, যা ভয়ঙ্কর সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
ব্ল্যাকমেইল, মানহানিকর কাজ এবং মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর কখনো আতঙ্কিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় এই আইনের আশ্রয় নিয়ে অপরাধীদেরকে শাস্তির আওতায় আনলে এই ধরনের অপরাধগুলো কমবে। বেশী বেশী শেয়ার করুন নিজের বন্ধুবান্ধবদের সাথে, কে জানি কে কোথায় কবে থেকে আতঙ্কে দুই চোখের পাতা এক করতে পারছে না?
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )