বেআইনি সমাবেশ

বিবিধ আইন

সাধারণত সভা সমাবেশ বললেই আমরা যেটা বুঝে থাকি সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জনসমাগম একসাথ হয়ে। এক বা একাধিক রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য শোনার জন্য যখন একটি নির্দিষ্ট স্থানে বহু মানুষ এক সাথ হয়, তখন তাকে আমরা সমাবেশ বলে থাকি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়াও কখনও কখনও রাষ্ট্র/ সমাজে সংগঠিত অপ্রীতিকর ঘটনার প্রতিবাদ কিংবা যে কোনো দিবস উদযাপনের জন্যও যখন লোকজন নির্দিষ্ট স্থানে এক সাথ হয়, তখন সেটিকে আমরা সভা সমাবেশ বলে থাকি। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে সমাবেশ হতে হলে অন্তত পাঁচজন ব্যক্তির এক সাথ হওয়া জরুরি। যখন কোন নির্দিষ্ট স্থানে পাঁচ বা তার অধিক ব্যক্তি একসাথে হবে, তখনই কেবল সেটিকে আমরা সমাবেশ বলতে পারব। সমাবেশ যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত লোকদের দ্বারাই সভা সমাবেশ হয়ে থাকে তা কিন্তু নয়। যে কোনও উদ্দেশ্যেই একটি সভা সমাবেশ হওয়া সম্ভব; যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যতীত আমরা যদি সচরাচর আমাদের সামনে ঘটতে থাকা যে সমাবেশগুলো হয়ে থাকে তার উদাহরণ টানি, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলের জন্য সভা সমাবেশ হয়ে থাকে, কোনও একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন কনসার্টের জন্য এক ধরনের ধরনের সমাবেশ হয়ে থাকে। তা ছাড়া সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক কোন সংগঠন তাদের দাবি-দাওয়া জানানোর জন্য যেমন গার্মেন্টস কর্মীরা তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সমাবেশ করে থাকে। আবার, রাষ্ট্রের বা সমাজের কোন কর্মকাণ্ডের বিপরীতে প্রতিবাদ করার জন্য সমাবেশ করা হয়ে থাকে। তবে মাথায় রাখতে হবে যে, ৫ (পাঁচ) এর কম যদি হয় যেমন তিন জন কিংবা চার জন বা দুই জন ব্যক্তিও যদি এক জায়গায় এক সাথ হয়, সেটিকে আমরা আইনের দৃষ্টিতে সমাবেশ বলব না। এখন কথা হচ্ছে, পাঁচ বা তার অধিক ব্যক্তি একটি জায়গায় এক সাথ হয়ে যদি কোন সমাবেশ করে, তখন কখন তা শুধু সমাবেশ আবার কখন তা বেআইনি সমাবেশ?

প্রথমেই বলে রাখি, একটি সমাবেশ করার জন্য যেহেতু একটি নির্দিষ্ট স্থান জরুরি, সেটি স্কুল কলেজের মাঠ কিংবা যেকোনো খোলা মাঠ কিংবা রাজপথের পাশে ও যদি সমাবেশ করতে হয় সেক্ষেত্রে অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসনের নিকট অনুমতি নিতে হবে। কেননা সমাবেশে যেহেতু অনেক মানুষ একসাথ হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে সেখানে যে কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। আবার অনেক সময় দেখা যায় একই স্থানে একই দিনে দুটি রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশের অনুষ্ঠান থেকে থাকে, সেই ক্ষেত্রে আরেকটি হট্টগোল হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তা ছাড়া একটি রাজনৈতিক দলের যদি সমাবেশ থাকে, অন্য আরেকটি রাজনৈতিক দল সেই সমাবেশে হামলা করার সম্ভাবনা থেকে থাকে, যার ফলে যে কোনও সমাবেশ করার আগে অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারপর সমাবেশ করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন যদি সমাবেশ করার অনুমতি না দেয় তারপরও কেউ যদি ওই আদেশ অমান্য করে সমাবেশ করে তাহলে সেটি অবশ্যই বেআইনি সমাবেশে রূপ নেবে।
তারপরও, আমাদের দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ১৪১ ধারায় বেআইনি সমাবেশকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে, কোন বেআইনি উদ্দেশ্য নিয়ে সমাবেশ করা হলে তাকে বেআইনি সমাবেশ বলা হবে। কিন্তু, উদ্দেশ্য যেহেতু বাহির থেকে বোঝা সম্ভব নয়, তাই আমরা কিছু উপাদানের ভিত্তিতে একটি সমাবেশ কখন বেআইনি সমাবেশে পরিণত হয়, সেটা বোঝার চেষ্টা করব:

  • সরকার বা আইন পরিষদ বা সরকারি কর্মচারীকে তার আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগ সম্পর্কে ভয় দেখালে,
  •  কোনও আইন বা আইনগত ব্যবস্থা বাস্তবায়নে বাধা প্রদান করলে,
  • অনিষ্ট বা অপরাধজনক অনধিকার প্রবেশ বা অপর যে কোনো অপরাধ সংঘটন করলে,
  • অপরাধজনক বলপ্রয়োগ করে কোনও ব্যক্তির সম্পত্তির কর্তৃত্ব অর্জন করা বা কোনও ব্যক্তিকে রাস্তা বা পানি ব্যবহার বা দখল থেকে বঞ্চিত করলে,
  • অপরাধজনক বলপ্রয়োগ করে কোনও ব্যক্তি যে কাজ করতে আইনত বাধ্য নয়, তাকে সেই কাজ করতে বাধ্য করা হলে অথবা কোনও ব্যক্তি আইনগত ভাবে যে কাজ করতে বাধ্য, তাকে সেই কাজ করা হতে বিরত রাখা হলে,

উপরিউক্ত এই পাঁচটি উপাদান দেখলে আমরা বুঝতে পারব একটি সমাবেশ কখন বেআইনি সমাবেশ হয়ে যাচ্ছে। আরও সহজ করে বললে, এই উপাদানগুলোর যে কোন একটি যে সমাবেশে আছে, সেটি বেআইনি সমাবেশ, আর উপরের একটি উপাদানও নেই যে সমাবেশে, সেটি ঠিক আছে।

এখানে মনে রাখতে হবে যে, সকল বেআইনি সমাবেশ শুরু থেকেই বেআইনি সমাবেশ থাকে তা কিন্তু নয়, অনেক সময় অনেক সমাবেশ আইনি সমাবেশ হিসেবে শুরু করলেও মাঝে ছন্দ হারিয়ে সেটি বেআইনি সমাবেশে পরিণত হতে পারে। তবে বেআইনি সমাবেশের সবচেয়ে মুখ্য বা আইনের দৃষ্টিতে সবচেয়ে ইউনিক/স্বতন্ত্র যে বিষয়টি রয়েছে, সেটি হচ্ছে যত জন ব্যক্তি মিলে একটি সমাবেশ করা হবে তাদের সকলের একটি সাধারণ উদ্দেশ্য থাকবে এবং সেটি হচ্ছে বেআইনি যা উপরের উপাদানগুলোর একটি।

তবে, যদি বেআইনি কোনও সাধারণ উদ্দেশ্য না থাকে, সেই ক্ষেত্রে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তার জন্য সকলকেই এর জন্য দায় করা যাবে না। যেমন ধরুন একটি সমাবেশে একশ জন ছাত্র যোগ দিয়ে একটি দাবি উত্থাপন করে সমাবেশ আহ্বান করল, তাদের যদি কোনও বেআইনি উদ্দেশ্য না থাকে, সে ক্ষেত্রে যদি এক বা একাধিক ছাত্র কোনোভাবে দলছুট হয়ে রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর করে, সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাদেরকেই তার জন্য দোষারোপ করা যাবে; এর জন্য পুরো সমাবেশের ১০০ ছাত্রকে দোষারোপ করা যাবে না।

 

কেননা দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ১৪৯ ধারাতে, সাধারণ উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনও বেআইনি সমাবেশের কোনো সদস্য দ্বারা উক্ত সমাবেশের সাধারণ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় এবং উক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কোন অপরাধ অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরাধ অনুষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ওই সমাবেশের সদস্যদের জানা থাকে, তাহলে এই ধরনের অপরাধ সংঘটিত অনুষ্ঠিত হবার সময় যেসব ব্যক্তি উক্ত সমাবেশের সদস্য থাকবে, তাঁদের প্রত্যেককেই সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হবে। এখন একটি আইনি সমাবেশের যদি উদ্দেশ্য থাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু স্লোগান বা কিছু বক্তব্য রাখা, সেই ক্ষেত্রে তাদের সাধারণ উদ্দেশ্য হচ্ছে এটি। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে কেউ যদি কোনও প্রকারের বিশৃঙ্খলা তৈরি করে সেই ক্ষেত্রে যেহেতু সেটি তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না, তাই শুধুমাত্র অপরাধের জন্য ঐ ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে। যেমন, একটি সমাবেশের মধ্যে যদি কেউ একজন আরেক জনের পকেট মেরে দেয়। এর জন্য পুরো সমাবেশটি পকেটমার, এটা তো আপনি বলতে পারেন না; বিষয়টি অনেকটা এরকম।

তবে কোনও বেআইনি সমাবেশের সাধারণ উদ্দেশ্য যদি থেকে থাকে কোন ব্যক্তিকে বা কয়েক জন ব্যক্তিকে খুন করার, সেই ক্ষেত্রে আপনি যদি বেআইনি সমাবেশের একজন সাধারণ সদস্য হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে সকল সদস্যের ন্যায় আপনিও খুনের জন্য দায়ী হবেন। অতএব কোনও সমাবেশে যোগ দেওয়ার আগে আপনি অবশ্যই জানতে হবে সেই সমাবেশটি বেআইনি কিনা। যদি বেআইনি সমাবেশ হয়ে থাকে তাহলে সেই সমাবেশে যোগদানের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আবার, আপনি যেহেতু সমাবেশে যাচ্ছেন সেই সমাবেশের সাধারণ উদ্দেশ্য কি সেটি আপনাকে জানতে হবে। কারণ সাধারণ উদ্দেশ্য যেটি সেটি যদি আপনার দ্বারা বাস্তবায়িত নাও হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে অন্য কোনও ব্যক্তি দ্বারা যদি সাধারণ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়ে থাকে, ওই অপরাধের জন্য আপনাকেও দোষী সাব্যস্ত করা যাবে।

এবার চলুন দেখি শাস্তি কেমন?
বেআইনি সমাবেশের শুধুমাত্র সদস্য হলেই আপনার অনধিক ছয় মাস বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। আর আপনি যদি মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেআইনি সমাবেশে যোগদান করেন, সে ক্ষেত্রে অনধিক দুই বছর বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। আবার, কোনও বেআইনি সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করার পরও যদি কেউ ঐ সমাবেশে যোগদান করে বা এই সমাবেশের সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং ছত্রভঙ্গের নির্দেশের পরেও অবস্থান করে, সেক্ষেত্রে তার শাস্তি হবে অনধিক দুই বছর। তাই, আশা করি বুঝে শুনে সমাবেশে যোগ দিবেন, ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.