মানহানি মামলা

মানহানি মামলা কখন হয় এবং শাস্তি কি?

বিবিধ আইন

মান আর হুঁশ, এই দুই মিলে মানুষ। যখন হুঁশ থাকে না তখন আমরা তাকে বেহুঁশ বলি আর যখন মান থাকে না তাকে আমরা গুরুত্ব দেই না। কিন্তু, মান আছে অথচ আমরা মান দেই না, তখন সেটা তাকে অসম্মান করা হয়। মানী লোককে মান দিতেই হবে, এটাই বাস্তবতা। তবে, মান না দিলেও সমস্যা নাই, যদি না আপনি তার মান নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করেন। আপনি মান সম্মান ওয়ালা লোককে সম্মান প্রদর্শন করবেন কি করবেন না, সেটা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত। ঠিক তেমনি, যার মান সম্মান আছে সেটাও তার একান্ত ব্যক্তিগত; এটাও এক ধরনের সম্পদের মতো। দেখবেন কোন কোম্পানি বিক্রি করার সময় সেই কোম্পানির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হিসেব করার সময় ‘গুড উইল’ও হিসেব করা হয় একটি টাকার অংকে। আপনি কারো মান সম্মান যখন নষ্ট করতে চাইবেন, তখন সেটি ঐ ব্যক্তির মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর আপনি যখন কারো মান সম্মান নষ্ট করতে চান বা করেন, তখন আইনের ভাষায় সেটিকে বলে মানহানি। মানহানি এমন একটি অপরাধ যার বিরুদ্ধে ফৌজদারি এবং দেওয়ানী উভয় প্রকারের প্রতিকার পাওয়া যায়। তাছাড়া, পূর্বে মানহানি সরাসরি বা অফলাইনে করা হলেও বর্তমানে অনলাইনেও মানহানি করা হয়ে থাকে। যার ফলে সাইবার আইনেও মানহানিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যার বিপরীতে রয়েছে শাস্তির বিঁধান।

দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৯৯ থেকে ৫০২ ধারা পর্যন্ত মানহানি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। দণ্ডবিধি অনুসারে, একজন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তির সুনাম বা মান বা খ্যাতি যেটাই আমরা বলি না কেন, যদি সেটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বা ঐ ব্যক্তির সুনাম/মান নষ্ট হবে জেনে শুনে শব্দের দ্বারা বা চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে বা কোন প্রতীক যা দৃশ্যমান তার মাধ্যমে নিন্দা প্রকাশ পায়, তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে উক্ত শব্দ/চিহ্ন/প্রতীক দ্বারা ঐ ব্যক্তির মানহানি করা হয়েছে। আপনি হয়ত ভাবছেন যে, এইভাবে হিসেব করলে তো চোরকেও চোর বলা যাবে না, কারণ এতে তার মানহানি হবে। কিন্তু, তা নয়। আপনি যেমন কারো সুনাম নষ্ট করার জন্য কোন নিন্দা প্রকাশ করতে পারেন না, তেমনি আপনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুনাম নষ্ট হলেও, মানহানি হলেও সত্য কথা বলতে পারবেন। সত্য বলতে আপনার কোন বাঁধা নেই, সেটি যেকোনো পর্যায়েই হোক না কেন। যেমন আপনি জনগণের কল্যাণে, সরকারী কর্মচারীর সরকারী কোন কাজে তার আচরণ সম্বন্ধে সরল বিশ্বাসে কিছু বললে, আদালতের কার্যবিবরণী প্রতিবেদন প্রকাশ করলে, জনসমস্যা বিষয়ে বা কোন ব্যক্তির আচরণ সম্বন্ধে সরল বিশ্বাসে কিছু বললে, গণ-অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মন্তব্য করলে, সরল বিশ্বাসে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দায়ের করলে, আদালতের সিদ্ধান্তে মামলার দোষ, গুন নিয়ে সরল বিশ্বাসে কথা বললে সেটি মানহানি হবে না। মানহানি হতে হলে অবশ্যই আপনাকে মিথ্যা কিছু বলতে হবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে। সরল বিশ্বাসে সত্য কথা বললে সেটি কোন মতেই মানহানি হচ্ছে না। যে চুরি করেনি, তাকে আপনি চোর বললে সেটা ঐ ব্যক্তির জন্য মানহানি হবে।

এবার আসুন জানি, মানহানি করলে কোন আইনে কি শাস্তির বিঁধান রয়েছে সেই বিষয়ে জানা যাক। দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৫০০ ধারা অনুযায়ী, মানহানির অপরাধের শাস্তি হচ্ছে ২ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। তবে, এই ২ বছরের কারাদণ্ড কিন্তু বিনাশ্রম।
তবে, মানহানি যে সবসময় অফলাইনে হবে তা কিন্তু নয়। বরং, বর্তমানে অনলাইনে আমরা অফলাইনের চেয়ে অনেক বেশী সময় কাটাই। ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ইত্যাদিতে আমরা এখন প্রতিনিয়ত সময় কাটাচ্ছি, এমনকি পত্রিকা পড়তে হলেও আমাদেরকে এখন অনলাইনে ক্লিক করতে হয়। এই যে আপনি এই অণুচ্ছেদটি পড়ছেন, তাও কিন্তু অনলাইনেই পড়ছে। এই অনলাইনেও কিন্তু মানুষ একজন আরেকজনের মানহানি ঘটাতে পারে। তাই, আমাদের সাম্প্রতিক সময়ে হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা ধারায় ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়ই। তবে কেউ যদি একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে তাহলে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়ই। মজার বিষয় হচ্ছে, ফেসবুকে মানুষ অসাবধানতা বশত এটা ঐটা লিখে ফেলে, যদি কোনভাবে সেটা কারো মানহানির কারণ হয়ে যায়, তাহলে আর দেখতে হবে না। ভাবুন তো, আপনার একটা কমেন্ট বা পোষ্টের কারণে যদি কারো মানহানি হয় আর ভিকটিম মামলা করে দেয়, তাহলে আপনার ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা হলো বা ৩ বছরের জেল?- ভাবা যায়? এই কারণে কারো মানহানি করার উদ্দেশ্যে কখনো কিছু পোষ্ট করা উচিত না।

এখন কথা হচ্ছে মামলা কে করবে, আপনার মানহানি হলে আপনি মামলা করতে পারবেন, আবার আপনার মৃত বাবা, মা বা কোন আত্মীয়ের যদি মানহানি হয়ে থাকে তাহলেও আপনি মামলা করতে পারবেন। তাছাড়া, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা মানসিক বা শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী কারো মানহানি করা হলে তার পক্ষে তার অভিভাবক মানহানির মামলা করতে পারবে। এককথায়, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তার পক্ষে অভিভাবক মানহানির মামলা করতে পারবেন।

তবে, মানহানির মামলা যে শুধু ফৌজদারি হবে তা কিন্তু নয়। কেউ আপনার মানহানি করলে যদি সেটি আপনার আর্থিক ক্ষতির কারণও হয়ে থাকে, তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলা করতে পারবেন। তবে, মানহানির মামলায় একটা মজার বিষয় হচ্ছে, আপনার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হলে আপনাকে ডিরেক্ট এরেস্ট করতে পুলিশ আসবে না। কেননা, এই মামলায় প্রথমেই ওয়ারেন্ট বা গ্রেফতারি পরোয়ানা বের হয় না। বরং, শুরুতে কেবল সমন জারি করা হবে, অর্থাৎ আপনাকে আদালতে উপস্থিত হয়ে মামলাটি নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে। কিন্তু, আপনি যদি সমন পাওয়ার পরও আদালতে উপস্থিত না হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে তখন গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হবে। তখন আপনাকে পুলিস এরেস্ট করে নিবে যাবে। শুধু মানহানির মামলাতেই নয়, যেকোনো মামলাতেই আপনার বিরুদ্ধে সমন জারি হলে আপনি যদি আদালতে হাজির না হোন, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট বা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হবে। তাই, সমন পাওয়ার সাথে সাথেই আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক নির্ধারিত তারিখে আদালতে হাজির হয়ে মামলায় নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করা উচিত।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.