সাক্ষীর স্মৃতি

আদালতে সাক্ষীর স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া

সাক্ষ্য আইন

বাংলা সিনেমায় আমরা ছোট বেলায় প্রায় দেখতাম যে, মাথায় আঘাত পাওয়ার পর নায়ক বা নায়িকার স্মৃতি শক্তি হারিয়ে যেতো, এরপর সে সবকিছু ভুলে যেতো। আবার, একই ভাবে মাথায় আঘাত পাওয়ার মাধ্যমে নায়ক বা নায়িকার স্মৃতি শক্তি ফিরে আসতো। এভাবেই সিনেমাতে মাথায় আঘাত করার মাধ্যমে স্মৃতি শক্তির সুইচ অন অফ করা হতো। মেডিক্যাল সাইন্সের সাথে এর কোন সম্পর্ক আদৌতে আছে কিনা জানি না, তবে স্মৃতি শক্তি পুনরুজ্জীবিত নিয়ে আদালতের বেশ ভালো সম্পর্ক আছে।
আমরা জানি সাধারণত একটি মামলার বিষয়বস্তু বা দাবী প্রমাণ করা হয় সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে। সাক্ষ্য ২ ধরনের হয়ে থাকে, দালিলিক এবং মৌখিক। দালিলিক সাক্ষ্য তো দলিল পত্রের বিষয়, দলিল বা নথির পক্ষে যা কিনা ভুলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু, মৌখিক সাক্ষ্য যেহেতু সাক্ষীকে নিজ স্মৃতি শক্তি থেকে উপস্থাপন করতে হয়, তাই এক্ষেত্রে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এখন কোন সাক্ষী আদালতে এলো সাক্ষ্য দিতে কিন্তু বেচারা ভুলে গেলো মামলার বিষয়বস্তু বা নির্দিষ্ট কোন একটি কথা বা বিষয়। তখন সাক্ষীর স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করতে পারে এমন কিছু বা তার নিজের বা তার নির্দেশে তৈরিকৃত অতীতের কোন লিখিত বিবৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। কেননা, আমাদের দেশে একটি মামলা চলে বছরকে বছর। এখন কোন মামলার সাক্ষী বা তদন্তের সাথে সম্পর্কিত কোন তদন্ত অফিসারের পক্ষে মামলার খুঁটিনাটি বিষয় বছরকে বছর মনে রাখা সম্ভব না। মানুষের মস্তিষ্ক তো আর মোবাইল, কম্পিউটারের মত হুবহু কোন বিষয় বছরের পর বছর মনে রাখতে পারে না, তাই আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসলে কোন স্মৃতি ভুলে গেলে সেটি পুনরুজ্জীবিত করা যায় বিভিন্ন উপায়ে।
ধরুন, কোন অভিযোগকারী থানায় ৫ বছর আগে এজাহার দায়ের করার সময় চুরিকৃত সম্পদের যে তালিকা দিয়েছিল, উক্ত মামলায় অভিযোগকারী আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় সেই তালিকায় থাকা সবগুলো সম্পদের হুবহু বিস্তারিত বলতে গিয়ে হিমশিম খেতে পারে বা ভুলেও যেতে পারে। তাই তখন তার স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এজাহারের কপি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ১৫৯ ধারায়, একজন সাক্ষীর ‘রিফ্রেশিং মেমরি’ বা স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত’র সাথে সম্পর্কিত। এটি একজন সাক্ষীকে একটি মামলার তথ্য সম্পর্কে তাদের স্মৃতিকে সতেজ করার জন্য যেকোনো নথি বা রেকর্ড ব্যবহার করতে দেয়।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ১৫৯ ধারা অনুসারে, যদি একজন সাক্ষী এমন কিছু ঘটনা মনে রাখতে না পারেন, যা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তবে তাকে ঘটনাটি ঘটার সময় বা ঘটনা ঘটার পরপরই নিজের বা অন্য কোনও ব্যক্তির দ্বারা করা কোনও লেখা উল্লেখ করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে অথবা তার স্মৃতি সতেজ করার জন্য কোনো নথি পরোখ করার জন্য। যাই হোক, সাক্ষী দলিল বা রেকর্ড থেকে পড়তে বা প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন না। তিনি কেবল তার স্মৃতিকে তাজা বা উন্নয়ন করার জন্য এটি ব্যবহার করতে পারেন এবং তারপরে তার নিজের স্মৃতি থেকে মামলার ঘটনাগুলো নিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন।

আদালতে স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তা
আদালতে স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যা মামলার সঠিক সমাধানে সাহায্য করতে পারে। স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত না করলে মামলাটি সঠিকভাবে নিষ্পত্তি হতে নাও পারে বা সাক্ষ্যের মানের অভাবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা নাও হতে পারে। আপনি যদি ভুলেই যান যে আপনার বিরুদ্ধে কি কি অপরাধ করা হয়েছিল তাহলে আপনার প্রতিপক্ষের সাথে আইনি লড়াইয়ে আপনি টিকে থাকতে পারবেন না।
সাক্ষীদের স্মৃতি শক্তি ঠিক থাকলে সেগুলো মামলার সঠিক সমাধানে সাহায্য করতে পারে। এটি আদালতে ন্যায্যতা এবং ন্যায়সঙ্গতি উন্নয়ন করতে পারে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বলা হয়ে থাকে, অর্ধেক সত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর (বক্স হবে)। সম্পূর্ণ ও সঠিক সাক্ষ্য না থাকলে ন্যায়বিচার করা কঠিন হতে পারে। তাই সঠিক সাক্ষ্য প্রদানের জন্য স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করা জরুরী।
সঠিক সাক্ষ্য প্রদান করা একটি মামলার মুখ্য উদ্দেশ্য। সক্ষম সাক্ষীদের স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করা আদালতে মামলার সঠিক বিচারে সহায়তা করে। তাছাড়া, যদি সক্ষম সাক্ষীদের স্মৃতি উন্নয়ন করা হয় তবে সেটি তাদের সাক্ষ্যের মান এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সেটি আদালতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভাল ভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।

 

স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যা যা করা যেতে পারে
স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সাক্ষী স্বয়ং তার নিজের নোট বা রেকর্ড ব্যবহার করতে পারে। এটি সম্পন্ন করতে সাক্ষীদের একটি অনুমতি লাগবে যেখানে স্বয়ং নোট বা রেকর্ড ব্যবহার করা যাবে। যেমন, পুলিশ তার ডায়রি ব্যবহার করতে পারেন। মানসিক অবস্থার পুনরুজ্জীবিত করতেও কিছু সাক্ষী তার স্মৃতিকে উন্নয়ন করতে পারেন এমন উপায় হলো তাদের মনের স্থানটি পুনরুজ্জীবিত করা। সাক্ষীর মনের স্থানটি উন্নয়ন করতে সাক্ষীদের সময় দেওয়া হয় যেখানে সে মনে করতে পারে ঘটনার বিবরণ।
মনোযোগ কেন্দ্রিকরণ করে স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে। এতে সাক্ষীর মনোযোগ কেন্দ্রিকরণ করে ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কিত তথ্যগুলো মনে করতে পারেন। স্মৃতি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে স্মৃতি উন্নয়ন করা যায়। যেমন একটি ছবি, মানচিত্র বা মনোচিত্র ব্যবহার করে একজন সাক্ষীর স্মৃতি উন্নয়ন করা যেতে পারে যার ফলে তার স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।

ইতিকথা, একটি মামলায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার করার জন্য সবচেয়ে সহায়ক হচ্ছে, মামলার পক্ষে সাক্ষ্য। সাক্ষ্য ঠিকঠাক উপস্থাপন করা হলে মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা মামলার সাথে সম্পর্কিত সাক্ষীদেরকে সাক্ষ্য ভুলে যেতে একরকম বাধ্য করে যার ফলে পরবর্তীতে সাক্ষীকে স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করতে হয়। তাই, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা দূরীকরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সাক্ষীদের মূল্যবান এবং তাজা সাক্ষ্যের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সবাই এগিয়ে আসতে হবে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.