false testimony

কিভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন করা হয়?

সাক্ষ্য আইন

আমরা দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ১৯১ ধারায় দেখেছি যে, কোন ব্যক্তি যদি আইনত বাধ্য হয় শপথের মাধ্যমে বা আইনের স্পষ্ট বিধান দ্বারা, সত্য প্রকাশ করার জন্য বা আইনত বাধ্য হয় কোন বিষয়ে একটি ঘোষণা দেওয়ার জন্য, তখন সে এমন কোন বিবৃতি দেয় যা মিথ্যা এবং যা সে হয় জানে বা বিশ্বাস করে যে তা মিথ্যা বা সে সত্য বলে বিশ্বাস করে না, সেক্ষেত্রে একে মিথ্যা সাক্ষ্য বলা হয়ে থাকে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন যে, “মিথ্যা কথার মধ্যেও মহত্ত্ব আছে। মিথ্যা কথা হাজার হাজার মানুষকে পাগল করে রাখতে পারে মিথ্যার মোহ দিয়ে। এমনকি কিছু কিছু মিথ্যা চিরকালের জন্যও সত্য হয়ে থাকতে পারে”। তাহলে বুঝুন, মিথ্যা বলা মহাপাপ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ মিথ্যাকে এমনভাবে সাজায় যে, মিথ্যা সত্যের মত হয়ে যায়। মিথ্যা কথা বা মিথ্যা সাক্ষ্য কিন্তু আপনাআপনি নাযিল হয় না; এটার পিছনে কারো না কারো দারুণ কারুকাজ রয়েছে।

আমরা আদালত পাড়ায় গিয়ে থাকলে তো দেখতেই পারবো, আর যারা আদালত পাড়ায় যাওয়া হয়নি, কিন্তু আশেপাশের মানুষদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তাহলেই শুনতে পারবেন যে, প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই কেউ না কেউ এখনকার যুগে মিথ্যা মামলার শিকার। উদাহরণ স্বরূপ, যদি আমরা নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলার কথাই তুলে ধরি, দেখবেন আপনার পরিচিত কেউ না কেউ আছে নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলার শিকার। এই মিথ্যা মামলা গুলোকে সাজানোর ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষী থেকে শুরু করে মিথ্যা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট পর্যন্ত প্রস্তুত করতে হয়। তাছাড়া, জমি জমার মিথ্যা মামলা গুলো ফাইলিং করার ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, জাল দলিল, জাল খতিয়ান প্রস্তুত করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

যার ফলশ্রুতিতে দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ১৯২ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন (Fabricating False Evidence) করেছে বলে তখনি পরিগণিত হবেন, যখন সে ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করতে এমন কোন ঘটনা ঘটায় বা এমন কোন দলিল বা নথি বা ডকুমেন্টস তৈরি করে বা প্রস্তুত করে যা মিথ্যা এবং যেটা উপস্থাপন করা হয়েছে, বিচারিক কার্যক্রমে বা সরকারী কর্মকর্তার নিকট বা কোন সালিশকারীর বরাবর। যদিও আমরা জানি যে, Arbitrator বা সালিশে আমাদের সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য নয়, তবুও আপনি যদি কোন Arbitrator বা সালিশে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করার উদ্দেশ্য মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন (Fabricating False Evidence) করাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, ১৯২ ধারা অনুযায়ী।

 

যেমন, জনাব করিম বিমান বন্দর থেকে বের হওয়ার সময় কিছু স্বর্ণের বিস্কুট জনাব সাগরের একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়, এই অভিপ্রায়ে যে সেগুলি সেই ব্যাগে পাওয়া যেতে পারে এবং এই পরিস্থিতিতে জনাব সাগর চুরির জন্য দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন৷ এখানে ১৯২ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন (Fabricating False Evidence) করেছেন।
তাছাড়া, জনাব সুমন তার দোকান বইতে বিচারিক আদালতে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে একটি মিথ্যা এন্ট্রি করে। এখানে ১৯২ ধারা অনুযায়ী, জনাব সুমন মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন (Fabricating False Evidence) করেছেন।
আবার, জনাব পলাশ একটি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের জন্য জনাব হারুককে দোষী সাব্যস্ত করার অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করে একজন সহযোগীকে উদ্দেশ্য করে জনাব হারুনের হাতের লেখার অনুকরণে একটি চিঠি লেখেন এবং চিঠিটি এমন জায়গায় রাখেন যা তিনি জানেন যে পুলিশ অফিসারদের তল্লাশির সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে ১৯২ ধারা অনুযায়ী, জনাব পলাশ মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন (Fabricating False Evidence) করেছেন।

 

শাস্তি
বিচারিক কার্যক্রমে মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবনের শাস্তি হচ্ছে, যেকোনো বর্ণনার ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। আর বিচারিক কার্যক্রম ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবনের শাস্তি হচ্ছে, যেকোনো বর্ণনার ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
গ্রিক নাট্যকার ইস্কিলুসের মতে, যুদ্ধের প্রথম শিকার হচ্ছে ‘সত্য’। সত্যকে আঘাত করেই সামনে এগিয়ে যায় শত্রু পক্ষ। সকল যুদ্ধের ক্ষেত্রেই দেখবেন যে, সত্যকে ছাপা দেওয়ার জন্য বা সত্যকে অস্বীকার করার জন্য বা সত্যকে ধূলিসাৎ করার জন্যই যুদ্ধ করা হয়। তবে এর বিপরীত মেরুও রয়েছে। মার্কিন কৌতুক অভিনেতা ও লেখক বিল মারি বলেন যে, আমরা যদি সরকারকে মিথ্যা বলি, তাহলে সেটি গুরুতর অপরাধ। কিন্তু, সরকার আমাদের সাথে মিথ্যা বললে, সেটি কি জানেন?- সেটি হচ্ছে রাজনীতি। হাস্যকর হলেও এটিই নাকি সত্য; যদি কেউ সরকারী কাজে কোথাও কোন তথ্য মিথ্যা দেয়, তাহলে সেটির জন্য তাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হয়। অথচ, সরকার মিথ্যা বললে তখন সেটি রাজনীতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি কৌতুক হিসেবে গ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তবে রাজনীতি করে দেশের জনগণই। তাই, জনগণ হিসেবে আমাদের প্রত্যেককেই মিথ্যা পরিহার করে চলা উচিত, অন্তত বিচারিক স্বার্থে। যে যার অবস্থান থেকে যদি মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন (Fabricating False Evidence) করা বন্ধ করে দেয় এবং মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা বন্ধ করে দেয়, তাহলে কিন্তু আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যের অভাবে মিথ্যা বা হয়রানি মূলক মামলা গুলো আপনাআপনি সমাপ্ত হয়ে যেত। তাছাড়া, ভবিষ্যতে যদি কেউ মিথ্যা বা হয়রানি মূলক মামলা করতে যায়, তখন মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন (Fabricating False Evidence) এর অভাবে মামলা করা থেকেই বিরত থাকবে।

নিম্নে বর্ণিত হাদিসটি স্মরণ করেই আমরা মিথ্যা সাক্ষ্য এবং মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন (Fabricating False Evidence) থেকে দূরে সরে থাকতে পারি:
আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সা:)-কে কবীরাহ গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া’।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.