শত্রু সাক্ষী

Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী / প্রতিকূল সাক্ষী

সাক্ষ্য আইন

বেন্থামের মতে, ‘witnesses are the eyes and ears of justice’ যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘সাক্ষীরা হচ্ছে চোখ ও কান, যার মাধ্যমে বিচারক তথা আদালত দেখতে পায় যে কে অপরাধ করেছে (guilty) আর কে নির্দোষ (innocent)। এখন এই সাক্ষীদের মধ্যে একটি ক্যাটাগরি আছে যাদের বলা হয়ে থাকে Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী। আজকের পর্বে আমরা জানার চেষ্টা করবো, কারা Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী আর কেনই বা তাদেরকে Hostile witness / বৈরী সাক্ষী বলা হয়ে থাকে।

সাধারণত একটি মামলায় নিজের দাবী প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রত্যেক পক্ষ আদালতে নিজেদের সাক্ষীকে তলব করে। নিজেদের সাক্ষী বলতে ঘটনার সাথে সম্পর্কিত যেমন, ঘটনা বা বিষয়টি দেখেছে বা অন্য যেকোনো ভাবে অবগত, তাদেরকে আদালতে এসে নিজেদের জবানবন্দী প্রদান করার জন্য তলব করা হয়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকে নিজেদের পছন্দ মত সাক্ষীদের তালিকা প্রদান করে এবং আদালতের নির্ধারিত দিন অনুযায়ী তাদেরকে হাজির করার বন্দোবস্ত করে। বাস্তব প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, আপনি আপনার কোন মামলা বা মোকদ্দমায় যদি কাউকে সাক্ষী হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়ে থাকেন, কেউই রাজি হতে চায় না। কারণ, মামলার তারিখ প্রায় প্রতি মাসেই নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং প্রতি তারিখে আদালতে উপস্থিত হতে কেউ চায় না। তাছাড়া, সাক্ষী হওয়া মানেই হচ্ছে আপনি যাই বলেন না কেন, সেটি সত্য হোক বা মিথ্যা, তা কারো না কারো পক্ষে যাবে এবং আপনাআপনিই আরেক পক্ষের বিপরীতে চলে যাবে। এই কারণে অনেকেই ‘অযথা শত্রু বানাতে চায় না’ বলে সাক্ষী হতেই রাজি হয় না। তার উপর একবার সাক্ষী হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেললে আদালত যখনি তলব করবে তখনি হাজির হতে হবে। এজন্য আপনি নিজে দৈনন্দিন কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নিজ পকেটের টাকা দিয়ে যাতায়াত খরচ বহন করে অন্যদের দাবী প্রতিষ্ঠা করা কতটা যুক্তিসঙ্গত মনে করবেন? এজন্য অনেকেই আছেন নিজের মামলার জন্য নিজের পছন্দের মনোনীত সাক্ষীর নাম দিয়ে থাকেন। এতে সময় মত যাতে ডাকলেই পাওয়া যায় এবং খরচ করতেও যাতে কোন পক্ষ থেকে সমস্যা না হয় তাই নিজের পছন্দের সাক্ষী দিয়ে থাকে অনেকেই, ওরা মামলার সম্পর্কিত হোক বা না হোক। আর সেখান থেকেই শুরু হয় বিপত্তি; যার শুরু সাক্ষী ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে। আদালত পাড়ায় অনেকেই আছেন, ভাড়াটিয়া সাক্ষী। ওদেরকে সাক্ষী হিসেবে ভাড়া করলে ওরা মামলার চাহিদা মত তাদের পেশা বা জীবিকা বানিয়ে নিয়ে মামলায় উকিলের শেখানো মতো জবানবন্দী দিয়ে থাকেন। এখান থেকেই শুরু হয় বিপত্তির। আপনি যদি আপনার আঙিনায় সাপ পুষেন আপনার প্রতিবেশীকে কামড়ানোর জন্য, তাহলে ঐ সাপ প্রতিবেশীদের যেমন কামড়াবে, একসময় আপনাকেও সুযোগ বুঝে ছোবল দিবে। তাই, যখন নিজের স্বার্থে প্রকৃত সাক্ষী না এনে ভাড়াটিয়া সাক্ষী আনবেন, তখন ঐ সাক্ষী আপনার টাকার জন্য যেমন আপনার পক্ষে বানানো সাক্ষ্য দিবে, তেমনি একটু বেশি টাকা দিলে আপনার সাক্ষী হয়েও আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে তারা কার্পণ্য করবে না।

 

যে পক্ষ যে সাক্ষীকে তলব বা আহ্বান করে, সে সাক্ষী সেই পক্ষেই সাক্ষ্য দিবে, এটাই হচ্ছে প্রত্যাশা। কিন্তু, যখন কোন সাক্ষী তাকে তলব করা পক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়, তখন তাকে বলা হয়ে থাকে, Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী। স্যার জেপি ওয়াইল্ড কোলস বনাম ক্যালস অ্যান্ড ব্রো, (১৮৬৬) এলআর পি এবং ডি ৭১ মামলার রায়ে বলা হয় যে, একজন Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী/প্রতিকূল সাক্ষী হচ্ছেন এমন একজন সাক্ষী, যিনি তার সাক্ষ্য দেওয়ার পদ্ধতি থেকে দেখান যে, তিনি আদালতে সত্য বলতে চান না। অর্থাৎ, Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী /প্রতিকূল সাক্ষী আদালতকে দেখাতে চান যে, আদালতে যে কারণে বা যে সাক্ষ্য দিতে আনয়ন করা হয়েছে তিনি সেই বিষয়ে আদালতকে সত্য বলতে ইচ্ছুক নন। আবার, জি এস বক্সী বনাম রাজ্য মামলার রায়ে বলা হয় যে, Hostile বা বৈরী বা প্রতিকূলতার অনুমানটি সাক্ষীর দেওয়া উত্তর থেকে এবং কিছুটা তার আচার-আচরণ থেকে অনুমান করা হয়। সুতরাং, একজন সাক্ষী যখন তাকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য আহ্বানকারী পক্ষের প্রতি তার মনোভাবের বিরোধী হয় বা যখন সে তা আড়াল করে, তখন তাকে Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী / প্রতিকূল সাক্ষী হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় যে, Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী হচ্ছে, ঘরের শত্রু বিভীষণ। আপনার সাক্ষী আপনার ঘরের লোকের মতোই, কেননা আপনার সাক্ষীই আপনার মামলা প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বড় অলংকার। কিন্তু, সেই সাক্ষী যখন আপনার বিরুদ্ধে চলে যায়, তখন উক্ত Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী ঘরের লোক হয়েও বিভীষণের ন্যায় কাজ করে।

তবে, ব্যতিক্রম ধর্মী নজীরও রয়েছে। সাক্ষী আনয়ন কারী পক্ষের স্বার্থে সাক্ষ্য না দিলেই যে একজন সাক্ষী Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়। ‘আর কে দে বনাম ওড়িশা রাজ্য’ মামলার রায়ে বলা হয়েছে যে, একজন সাক্ষী যদি সত্য কথা বলেন এবং তার সাক্ষ্য তাকে আহ্বানকারী পক্ষের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তবে তা একজন সাক্ষীর Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। একজন সাক্ষীর প্রাথমিক আনুগত্য হচ্ছে, সত্যের প্রতি, তাকে আহ্বানকারী পক্ষের প্রতি নয়। তাই, শুধুমাত্র Hostile বা বৈরী বা প্রতিকূল সাক্ষ্য একজন সাক্ষীকে Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী ঘোষণা করে না।

উল্লেখ্য, নিজের সাক্ষীকে সাধারণত জবানবন্দী এবং পুনঃজবানবন্দীর জন্য আহ্বান করা যেত। আর জেরা করতে পারে অপরপক্ষ। কিন্তু, যখন নিজের সাক্ষী Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী/প্রতিকূল সাক্ষী হয়ে যায়, তখন নিজের সাক্ষীকেই জেরা করা যায়। এটি সাক্ষ্য আইনে সাক্ষ্য গ্রহণের যে স্বাভাবিক নিয়ম তার ব্যতিক্রম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.