তামাদি আইন

তামাদি মেয়াদ গণনা পদ্ধতিঃ পর্ব ০৪

তামাদি আইন বিবিধ আইন

তামাদি আইন ১৯০৮ এর তৃতীয় অধ্যায়ে তামাদির মেয়াদ গণনার রীতিনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আগের পর্বগুলোতে নয়টি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা শেষে এই পর্বে আরো কিছু পয়েন্ট নিয়ে উদাহরণ সহ সহজ ভাষায় বর্ণনা দেওয়া হবে। শুধুমাত্র আইনের ধারাভাষ্য বা ধারাভিত্তিক পর্যালোচনা করলে আইনের ছাত্রদের জন্য সহজতর বা বোধগম্য হলেও সাধারণ মানুষের জন্য সেটি তখনও কষ্টসাধ্য তাই যথাসম্ভব বাস্তব সম্মত উদাহরণ দিয়ে সকল শ্রেণীর পাঠকদের জন্য সহজলভ্য করে তোলার চেষ্টা করতে গিয়েই হয়ত একটু বেশীই ধীর গতিতে এগোতে হচ্ছে। সেই গতিতেই আজকের পর্বে আমরা যা আলোচনা করবো তা পয়েন্ট আকারে নিম্নরূপ:

১০। তামাদি আইনের ২০ ধারা অনুযায়ী, উত্তর দায় সংক্রান্ত ঋণ পরিশোধের অথবা সুদ প্রদানের ফলাফল বন্ধকী জমির ফসল প্রাপ্তির রসিদের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রায় ১০০ বছর আগের ভাষ্যমতে জটিলতার কারণে যতটা কষ্টসাধ্য মনে হচ্ছে, আসলে বিষয়টা ততটা জটিল নয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা ৯ নং পয়েন্টটায় দেওয়া উদাহরণটাকে পুনরায় ব্যবহার করতে পারি। যেমন, আপনার কাছ থেকে কেউ টাকা ধার নিলো এবং একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে উক্ত টাকা বাবদ কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়। এখন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সময়ের মধ্যে আপনার পাওনা টাকা পরিশোধ করা না হলে আপনি ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এখন এই পরিস্থিতিতে আপনার তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে যখন আপনার দেনাদার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সময়ের মধ্যে আপনাকে আপনার অর্থ পরিশোধ করবে না, তখন থেকে এখন ২০ ধারাতে বলতে চাচ্ছে, যদি আপনার দেনাদার আপনার কাছ থেকে ধার নেওয়া অর্থ নির্ধারিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে উক্ত দেনা বা দায় ২০ এর বিপরীতে নির্ধারিত সুদ পরিশোধ করতে পারে, তাহলে উক্ত অর্থ প্রদানের তারিখ থেকে নতুন করে তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু করতে হবে। অর্থাৎ, শুধু ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে যেখানে নিয়মটা আমরা বুঝতে পেরেছি, সেখানে এই ধারায় শুধু বাড়তি হচ্ছে সুদ বা ইন্টারেস্ট। ধার বা দায়ের সুদ হিসেবে যে অর্থ নির্ধারণ করা হয়েছে সেই অর্থ যে তারিখে পরিশোধ করা হবে সেই তারিখ থেকে নতুন করে তামাদি মেয়াদ গণনা করতে হবে। আগের পয়েন্টের সাথে এই পয়েন্টে পার্থক্য একটাই, আগের পয়েন্টে লিখিত প্রাপ্তি স্বীকার করার দিন থেকে নতুন করে তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে আর এই পয়েন্টে হচ্ছে ধার বা দায়ের বিপরীতে সুদ।

১১। ৯ এবং ১০ নং পয়েন্টে আমরা আলোচনা করেছিলাম যে, যে ব্যক্তি ধার বা ঋণ নেয়, সে ব্যক্তি স্বয়ং নিজে বা তার থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি দ্বারা তার ঋণ বা দায় এবং এর বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে পারবে। এখন এখানে কারো পক্ষে যথাবিহিত রূপে ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রতিনিধি বলতে অপারগতাগ্রস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার আইন সম্মত অভিভাবক কমিটি বা ম্যানেজার কর্তৃক স্বীকৃতি স্বাক্ষর করার বা অর্থ প্রদান করার জন্য ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তিকে বুঝানো হবে। তবে যা কিছুই হোক না কেন, যৌথ চুক্তিকারী, অংশীদার, নির্বাহক বা বন্ধকগ্রহীতাদের মধ্যে একজনের বা একাধিক জনের প্রতিনিধির স্বাক্ষরিত কোন লিখিত স্বীকৃতির জন্য অপর কাউকে কোন দেনার জন্য দায়ী করা যাবে না।


তামাদি আইনের ২১ ধারা মূলত, হিন্দু আইনের আওতাধীন কোন বিধান বা কোন সম্পত্তিতে সীমিত স্বত্বে স্বত্ববান কোন ব্যক্তি বা তার যথাবিহিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি কোন দায়ের জন্য লিখিত স্বীকৃতি বা অর্থ প্রদান করে (যা আমরা ৯ এবং ১০ নং পয়েন্টে আলোচনা করেছি) তবে তা পরবর্তী উত্তরাধিকারীর প্রতিকূলে বৈধ স্বীকৃতি বা অর্থপ্রদান হিসেবে গণ্য হবে।
আবার, যৌথ বা অবিভক্ত হিন্দু পরিবার বা তাদের পক্ষে কেউ কারো কাছে দায়গ্রস্ত হলে, সেই পরিবারের ম্যানেজার বা তার ক্ষমতা প্রাপ্ত কোন প্রতিনিধি কোন স্বীকৃতি দান বা অর্থ প্রদান করে (বলা বাহুল্য, ৯ এবং ১০ নং পয়েন্ট), তা পুরো অবিভক্ত বা যৌথ পরিবারের পক্ষে স্বীকৃতি দান বা অর্থ প্রদান করা হয়েছে বলে বিবেচিত হবে।

১২। একটি মামলা চলমান অবস্থায় যদি মামলার প্রয়োজনে বা পক্ষদ্বয়ের তাগিদে নতুন করে বাদী বা বিবাদীকে স্থলাভিষিক্ত বা পক্ষভুক্ত করা হয়, তবে নতুন করে যে বাদী বা বিবাদীকে পক্ষভুক্ত বা স্থলাভিষিক্ত করা হচ্ছে, তার জন্য মামলাটি ঐ দিনই দায়ের করা হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। কেননা, নতুন বাদী বা বিবাদী মামলাতে বিভিন্ন দরখাস্ত বা কার্যবিধি অনুসরণ করতে হবে যা তামাদি আইনেও আওতাভুক্ত। ফলে যে বাদী বা বিবাদী মামলার মাঝপথে পক্ষভুক্ত হল, সে ঐ তামাদি মেয়াদ থেকে বিচ্যুত হবে। তাই, আইনবলে ধরে নেওয়া হবে মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার দিনই নতুন বাদী বা বিবাদীর জন্য মামলা দায়েরের তারিখ হিসেবে বিবেচিত হবে।
তবে, তামাদি আইনের ২২ ধারায় বলে দেওয়া আছে, মামলা মূলতবী থাকাবস্থায় স্বত্বাপর্ণ বা কোন স্বত্ব হস্তান্তরের কারণে কাউকে পক্ষভুক্ত বা স্থলাভিষিক্ত করা হয় বা বাদীকে বিবাদীতে কিংবা বিবাদীকে বাদীতে রূপান্তর করা হয় তাহলে সেই ক্ষেত্রে মামলাটি নতুন বাদী বা বিবাদীর জন্য ঐ দিন দায়ের করা হয়েছে বলে বিবেচিত হবে না; বরং মামলাটি প্রকৃতই যেদিন দায়ের হয়েছিল, সেই দিনই ধরা হবে।

১৩। আপনি আমার সাথে কোন চুক্তি করেছেন; এখন আমি উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করলাম। তাহলে চুক্তি ভঙ্গের কারণে আপনার মামলা দায়েরের তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে চুক্তি ভঙ্গের সময় থেকে। কিন্তু আমি যদি চুক্তিটি অবিরাম ভঙ্গ করতে থাকি, তখন কি হবে?- উত্তর সহজ। অবিরাম বা বারংবার চুক্তি ভঙ্গের ফলে প্রতি মুহূর্তেই নতুন করে তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে। অর্থাৎ একাধিক সময়ে চুক্তি ভঙ্গ হোক বা অন্যায় করা হলে, সর্বশেষ যেদিন চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে বা অন্যায় করা হয়েছে, সেদিন থেকেই তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু করতে পারবো বা আপনিও পারবেন।

১৪। আপনার জমির পাশের জমির মালিক তার জমিতে এমনভাবে মাটি খনন করে বা বালি উত্তোলন করে বিক্রি করতেছে যে, এতে আপনার জমিরও ক্ষতি হতে পারে; যেমন আপনার জমির পাড় ভেঙ্গে যেতে পারে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে ঐ লোক আপনার কোন ক্ষতি করতেছে না, কারণ সে তার নিজ জমি থেকে মাটি বা বালি তুলছে। এই ধরণের ক্ষেত্রে যখনি কারো বাস্তবিক ক্ষতি হয়, সেদিন থেকে মামলার তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হয়। অর্থাৎ, আপনাকে আপনার জমির ক্ষতিসাধন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তামাদি আইনের ২৪ ধারায় সুন্দর করে বলা হয়েছে যে, কার্যের ধরুন ক্ষতিপূরণের মামলার জন্য যখন ‘ক্ষতি’ হয়, তখন থেকে তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হয়। এখানেই শেষ হল তামাদি আইন অনুসারে মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিলের জন্য তামাদির মেয়াদ গণনা পদ্ধতি। তবে, সর্বোপরি আমি বলবো, মামলা করার কারণ তথা কজ অফ একশন সৃষ্টি হওয়া মাত্রই মামলা দায়ের করা উচিত, কেননা পূর্বেই বলেছি, আইন অলস ব্যক্তিকে সহায়তা করবে না।

 

[ বাকি পর্বগুলোঃ পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩  ]

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.