সন্তানের সম্পত্তিতে পিতার উত্তরাধিকার

সন্তানের সম্পত্তিতে বাবার অধিকার

বলা হয়ে থাকে পৃথিবীতে নাকি সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে বা সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য হচ্ছে বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। কোথায় সন্তান কাঁধে বয়ে নিয়ে যায় তার বাবাকে, সেখানে কোলে পিঠে মানুষ করা সন্তানকে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দেওয়ার জন্য বাবা নিজে যখন সন্তানকে কবরে নিয়ে যায়, তা শুধুমাত্র বাবারাই বুঝতে পারেন। আজকে আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো সেটি অনেকটা পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ এমন কোন দৃশ্যের এই ফলশ্রুতি। আজকে আমরা আলোচনা করছি পিতা হিসেবে উত্তরাধিকারসূত্রে যতটুকু সম্পত্তি পেতে পারেন। যেহেতু পিতা উল্লেখ করা হচ্ছে এর মানে হচ্ছে সন্তানের মৃত্যুতে সন্তানের সম্পত্তি থেকে পিতা উত্তরাধিকার হিসেবে কতটুকু সম্পত্তি পেতে পারেন সেই সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। কোথায় পিতার মৃত্যুতে সন্তান উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি পায়, পিতা তার সারাজীবনের উপার্জন রেখে যায় তার সন্তানদের জন্য; অথচ সন্তানের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে এখন পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে হক আদায় করতে হচ্ছে; এটা কতটা সুখের আর কতটা বেদনার, সেটা পাঠকই ভালো বলতে পারবেন। যাই হোক, আর্টিকেলটি পড়ার সময় নিজেকে যদি রিলেট বা সম্পৃক্ত করতে পারেন তাহলে আর্টিকেলটি মুহূর্তের মধ্যে অনেক বেশি সহজ হবে আপনার জন্য। উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের হিসেব গুলো ধীরে সুস্থে এবং নিজেকে আর্টিকেলের একটি চরিত্র হিসেবে চিন্তা করে সামনে অগ্রসর হলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। প্রথমে বলে রাখি পিতা সন্তানের কাছ থেকে ৩ (তিন) ভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেতে পারেন।

প্রথমত, মৃত সন্তানের যদি কোন সন্তান থাকে অথবা ছেলে সন্তানের সন্তান থাকে সে ক্ষেত্রে ১/৬ (ছয় ভাগের এক ভাগ) অর্থাৎ আপনার সন্তান মারা গেছে তার কোন সন্তান রয়েছে অর্থাৎ আপনার নাতনি নাতনির হয়েছে অথবা আপনার নাতির কোন সন্তান রয়েছে সেক্ষেত্রে আপনার যে সন্তান মারা গেল তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ১/৬ বা ছয় ভাগের এক ভাগের মালিকানা আপনি পাবেন।

এবার আসুন দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটে, যখন আপনার মৃত ছেলের কোন সন্তান থাকবে না আবার মৃত ছেলের ছেলের কোন সন্তান থাকবে না অর্থাৎ আপনার নাতি নাতনি থাকবে না বা কোন নাতিরও সন্তান থাকবে না, তখন আপনি পিতা হিসেবে আপনার মৃত ছেলের যে সম্পত্তি রয়েছে সেখানে শেয়ারার লিস্টে যারা রয়েছে, তাদেরকে দেওয়ার পরে অবশিষ্ট অংশটুকু আসাবা লিস্টে চলে যাবে আর আসাবা হিসেবে আপনি উক্ত সম্পত্তিটুকু পেয়ে যাবেন।

এবার আসুন তৃতীয় এবং সর্বশেষ প্রেক্ষাপটে, একটু জটিল তবে এক্ষেত্রে সম্পত্তির পরিমাণ একটু বেশি। যখন আপনার মৃত সন্তানের কোন ছেলে থাকবে না অর্থাৎ আপনার কোন নাতি থাকবে না বা আপনার নাতির কোন সন্তান থাকবে না কিন্তু আপনার এক বা একাধিক নাতনি থাকবে অথবা নাতির এক বা একাধিক মেয়ে থাকবে, তখন আপনি পিতা হিসেবে আপনার মৃত ছেলের ১/৬ (ছয় ভাগের এক ভাগ) অংশ পাবেন এবং অন্যান্য সকলকে দেওয়ার পরে যদি আরও সম্পত্তি থেকে থাকে সেই অংশটুকু আপনি পাবেন অর্থাৎ আসাবা হিসেবেও আপনি সম্পত্তি পাবেন।

এই হচ্ছে পিতা হিসেবে মৃত সন্তানের কাছ থেকে যে তিন ভাবে আপনি সম্পত্তি পেতে পারেন। এক্ষেত্রে মৃত সন্তান ছেলেও হতে পারে আবার মেয়েও হতে পারে। ছেলে মেয়ে ভেদে পিতার উত্তরাধিকারে কোন পার্থক্য হবে না। শুধু ছেলের বেলায় ছেলের স্ত্রীর দেনমোহরের হক বাকি থাকলে তা আগে পরিশোধ করে তারপর সম্পত্তি বণ্টন করতে হবে।

 

আসাবা হিসেবে সম্পত্তি পাওয়ার বিষয়টি যাদের কাছে নতুন বা বোধগম্য নয় তাদের জন্য বলছি যে, মুসলিম আইন অনুসারে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রথমেই ১২ জনের একটি লিস্ট রয়েছে যাদেরকে শেয়ারার বলা হয়; প্রথমে তাদেরকে সম্পত্তি বণ্টন করতে হয়। এই ১২ জনকে সম্পত্তি দেওয়ার পরে যদি কোনো সম্পত্তি বেচে থাকে সেটাকে বলা হয় আসাবা। আসাবারও আবার একটি ছোট লিস্ট রয়েছে। তো চলুন প্রথমে দেখি আমরা ১২ জনের লিস্টে কে কে আছে তাদেরকে দেখে আসি।

  •  স্বামী,
  •  স্ত্রী,
  •  পিতা,
  •  মাতা,
  •  দাদা,
  •  দাদী/নানী
  •  কন্যা
  •  পুত্রের কন্যা (নাতনি)
  •  আপন বোন
  •  বৈমাত্রেয় বোন (বাবা এক, মা ভিন্ন)
  •  বৈপিত্রেয় ভাই (মা এক, বাবা ভিন্ন)
  •  বৈপিত্রেয় বোন

এই হচ্ছে মোট ১২ জনে শেয়ারার লিস্ট। এদেরকে দেওয়ার পর যা বাকি থাকবে তা চলে যাবে আসাবা লিস্টে। আসাবা লিস্টে সাধারণত চারটি ডিগ্রী অনুসরণ করা হয়।

  •  প্রথমত, মৃত ব্যক্তির নিজের বংশধর। ছেলে, ছেলের ছেলে এভাবে নিচের দিকে যতদূর যাওয়া যায়।
  •  তারপরে মৃত ব্যক্তির পূর্ববর্তী বংশধর। পিতা, দাদা এভাবে উপরের দিকে যতদূর যাওয়া যায়।
  •  তারপর মৃত ব্যক্তির আপন ভাই, বোন, সৎ ভাই বোন, তাদের ছেলেরা।
  •  তারপর মৃত ব্যক্তির আপন চাচা, সৎ চাচা ইত্যাদি।

পিতা ১২ জনের তালিকাতেও রয়েছে আবার আসাবা তালিকাতেও রয়েছে। এজন্যই বাবা, দাদা শেয়ার হিসেবেও সম্পত্তি পেয়ে থাকে আবার আসাবা তালিকা থেকেও সম্পত্তি পেয়ে থাকে। বাবার উত্তরাধিকার বুঝলে দাদাকে নিয়ে আরেকটি আর্টিকেল লেখার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা পিতা উত্তরাধিকারসূত্রে যেভাবে সম্পত্তি পেয়ে থাকে একইভাবে দাদা ও মৃত নাতি নাতনির কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেতে পারবেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে যদি বাবা জীবিত থাকে তাহলে বাবা পাবেন আর বাবা যদি না থেকে থাকে এবং উপরে উল্লেখিত যে তিনটি কন্ডিশন বলা হয়েছে ওই কন্ডিশন গুলোর যেকোনোটি মিলে যায়, সেক্ষেত্রে বাবার অবর্তমানে দাদা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবেন। এটাকে বলা হয়, একজনের উপস্থিতিতে আরেকজন বঞ্চিত হওয়া৷ নিকটবর্তী আত্মীয়ের কারণে দূরবর্তী আত্নীয় উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। পিতা বা বাবা থাকলে দাদা বঞ্চিত হবেন৷ পিতার অনুপস্থিতিতেই কেবল দাদা সম্পত্তি পাবেন। বাবার অবর্তমানে নাতি বা নাতনির মৃত্যুতে দাদা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাচ্ছে, এমন উদাহরণ আমার অন্তত দেখা হয়নি, আপনি দেখেছেন, দেখলে অবশ্যই আমাদেরকে জানাবেন। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবো।
ধন্যবাদ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই