ধর্ম পরিবর্তন করার আইনি নিয়ম

ধর্ম হচ্ছে একটি বিশ্বাসের বিষয়, যা ধরাও যায় না, দেখাও যায় না। আমির খানের ‘পিকে’ (PK) সিনেমার ওই দৃশ্যটি কথা মনে আছে, যখন আনুশকা শর্মা বিভিন্ন ধর্মের একজন ব্যক্তিকে সাজিয়ে মন্দিরে বাবাজির সামনে দাঁড় করিয়ে ছিলেন আর বলেছিলেন এদের কার কি ধর্ম সেটা সম্বন্ধে বলতে। তখন বাবাজি পোশাক-আশাক আর বাহ্যিক বেশভূষা পরোখ করে একেক জনকে একেক ধর্মের অনুসারী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন; হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রিস্টান ইত্যাদি। পরোক্ষণে আনুশকা শর্মা বাবাজিকে ভুল প্রমাণ করে দেখিয়ে ছিলেন যে, তাদের মধ্যে কেউ তাদের বাহিরের যে বেশভূষা ছিল সেই অনুসারে তাদের ভেতরকার ধর্ম অনুসরণ করেন না। আনুশকা চালাকি করে তাদের প্রত্যেকের বাহ্যিক দিক পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন।
আমরা শুধুমাত্র বাহিরের বিষয়টা দেখেই মানুষদেরকে বিচার করি, যেমন দাড়ি-টুপি থাকলেই মুসলমান, ধুতি পরা থাকলে হিন্দু, সমস্ত গায়ে হলুদ কাপড় মুড়িয়ে থাকলেই বৌদ্ধ আর ইংরেজদের মত বেশভূষা থাকা লোকদেরকে আমরা খ্রিষ্টান বলে থাকি। যদিও আমাদের ধারণা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক থাকে, কিন্তু এখন পোশাক বা বাহ্যিক বেশভূষার দিক থেকে সারা বিশ্বেই একটা নিরপেক্ষ আমেজ তৈরি হচ্ছে। এখনকার যুগে হিন্দু, মুসলমানরা খ্রিস্টানদের এর মত কাপড়চোপড় পরে; এমনকি বৌদ্ধরাও নিজ ধর্মের বাহিরে এসে সাধারণ পোশাক আশাকে অভ্যস্ত হচ্ছে। যার ফলে এখন আর বাহিরের পোশাক-আশাক দিয়ে কারো ধর্ম চেনাটা সহজ নয়, পাশাপাশি উচিতও নয়। পোশাক আসলে একটি কালচারাল বা সাংস্কৃতিক উপাদান যার সাথে ধর্মের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে, কোন কালচার যদি ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত হয় বা ধর্ম থেকে সংস্কৃতির অবয়ব তৈরি হয় তখন হয়তো পোশাক-আশাকে ধর্মের ছাপ থাকতে পারে; যদিও স্বতন্ত্র জাতির ধারনাটা এখন ক্রমশ কমছে, কমছে সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতা; তৈরি হচ্ছে একটি মিশ্র জাতি ও সভ্যতার।



আমেরিকার মতো দেশে এখন জাতীয় পরিচয়পত্রের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়টি থাকে না, সেটি আমাদের দেশেও থাকে না। কিন্তু আমরা নাম পরেই বুঝতে পারি কে কোন ধর্মের। যেহেতু পাশ্চাত্যের তুলনায় আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্ম চর্চার পরিমাণ বেশি আবার ধর্মের বাড়াবাড়িও আমাদের এই অঞ্চলে বেশি, সেই ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ধর্মীয় পরিচয়টি আমাদের জাতীয় পরিচয় পত্রের না থাকলেও আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি অর্থাৎ সার্টিফিকেটে আমরা কে কোন ধর্মের অনুসারী, সেটি উল্লেখ করা থাকে। যার ফলে কখনো যদি আমাদেরকে আমাদের ধর্ম পরিবর্তন করতে হয়, সেই ক্ষেত্রে সেটি শুধু মৌখিক ঘোষণা দিলেই হয় না, বরং আইনি কাগজপত্রের মাধ্যমে সকলকে জানিয়ে তারপর ধর্মান্তর সম্পন্ন হয়। আমি পটভূমিতেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যে, ধর্ম এমন একটা বিষয় যা ধরা যায় না, দেখাও যায় না। যার ফলে কেউ যদি ধর্ম পরিবর্তন করে সেই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তার মুখের কথার ভিত্তিতেই সেটি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই তাকে ঘোষণা দিয়ে আইনি কাগজ পত্রের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করতে হয়। আমাদের দেশে বর্তমানে ধর্ম পরিবর্তন করার যে বিষয়টি আমরা সচরাচর দেখে থাকি সেটি হচ্ছে নোটারি পাবলিকের সামনে নিজের এক্সিস্টিং বা বর্তমান পরিচয় প্রকাশ করে তা থেকে নতুন যে পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় সেই পরিচয়টি প্রকাশ করে এফিডেভিটের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে ভবিষ্যতের নতুন নাম পরিচয় ঘোষণা করতে হয়। যেহেতু আমরা ধর্ম পরিবর্তন করলে, সাথে সাথে নামের পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে, সে ক্ষেত্রে এফিডেভিটে নাম এবং ধর্মের পরিবর্তন দুটোই উল্লেখ করতে হয়; যদিও নাম ও ধর্মের জন্য আলাদা আলাদা এফিডেভিট করা সম্ভব। কারো কারো মতে ধর্ম ও নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একই এফিডেভিট এর মাধ্যমে পরিবর্তন করা একরকম অবশ্যম্ভাবী, কেননা ধর্ম পরিবর্তন করার পর যখন নামের পরিবর্তন করা হয় তখন সেটি অবশ্য জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। জাতীয় পরিচয় পত্র সংশোধন করতে হলে অবশ্যই সেটি নোটারি পাবলিক এর মাধ্যমে এফিডেফিট করে তারপর করতে হবে। তাই এখন কেউ একজন যদি তার ধর্ম পরিবর্তন করতে চাই অর্থাৎ এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে চায় সেক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই এফিডেভিটের মাধ্যমে ঘোষণা দিতে হবে যে, সে পূর্বে এই ধর্মের অনুসারী ছিল, আজ থেকে এই নতুন ধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছে এবং সেটা সম্পূর্ণ নিজের স্ব-ইচ্ছায়, কারো কোন ধরনের প্ররোচনা বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়। এর জন্য অবশ্য নোটারি পাবলিকের কাছে যথেষ্ট সাজানো-গোছানো ফরমেট রয়েছে; সেখানে গিয়ে কেউ একজন শুধুমাত্র তার পরিচয় পত্র দেখালে সেটি অনুসারে তারা এফিডেভিট তৈরি করে দেবে। এটি তো গেল, সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ার বিষয় যেটি বাহ্যিক দিক থেকে দেখা যায় কিন্তু যেহেতু ধর্ম আসলে দেখা যায় না, শুধু অন্তরে ধারণ করতে হয়, সে ক্ষেত্রে কেউ একজন তার ধর্ম পরিবর্তন করতে হলে, নতুন যে ধর্মে আসবে সেই ধর্মের একজন ধর্মীয় নেতার মাধ্যমে উক্ত ধর্মের ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে ধর্মান্তরিত হতে হবে। যেমন মুসলমানদের ক্ষেত্রে একজন ইমামের হাতে কলেমা পড়ে তাকে ধর্মান্তরিত হতে হবে অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে, তেমনি হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে পুরোহিতের মাধ্যমে, খ্রিষ্টান ধর্মের ক্ষেত্রে চার্চের ফাদার। তবে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে সুন্নতে খতনার বিষয়টিও রয়েছে।

এখন একটু আলোচনা করা যাক, ধর্ম পরিবর্তন করলে আইনি যে অধিকার তৈরি হয় পাশাপাশি যেসব অধিকার খর্ব হয়। একজন ব্যক্তি যখন তার ধর্ম পরিবর্তন করে সেক্ষেত্রে তার অধিকারের বিষয়টি আসলে খুবই সীমিত, সেটি হচ্ছে যে নতুন যে ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে সেই ধর্ম অনুসারে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে পার্সোনাল আইন অনুসারে সেই ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে। কিন্তু ধর্ম পরিবর্তন করলে তার অধিকার খর্ব হওয়ার তালিকাটা বেশ লম্বা। প্রথমত একজন ব্যক্তি যখন তার ধর্ম পরিবর্তন করে তখন সে তার আগের ধর্মের সকল ধরনের বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত হয়ে যায় যার ফলে আগের ধর্ম অনুসারে সে যদি কোন সম্পদ উত্তরাধিকারসূত্রে পেতে পারতো, সে সম্পদ থেকেও সে বঞ্চিত হবে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে তার বাবা-মা বা যারা মারা গেলে সে উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু সম্পত্তি পাওয়ার কথা সেই ধরনের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ আমরা জানি যে, উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের বিষয়টি সম্পূর্ণ নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে হয়ে থাকে, কিন্তু এখন কোন ব্যক্তি যদি তার ধর্ম পরিবর্তন করে ফেলে সে ক্ষেত্রে তার আগের ধর্ম বা ধর্মীয় আইন তার উপর প্রযোজ্য নয় বিধায় উত্তরাধিকার হিসেবে কোন সম্পত্তি পাবে না। পাশাপাশি তাঁর প্রাক্তন ধর্মের কেউ যদি তার জন্য কোনো সম্পত্তি উইল করে থাকে সেই উইলও বাতিল হয়ে যাবে তার ধর্ম পরিবর্তন করার কারণে। আবার, কোন ব্যক্তি যদি তার ধর্ম পরিবর্তন করে তাহলে তার স্বামী বা স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে; যদি তারা উভয়েই ধর্ম পরিবর্তন করে সেই ক্ষেত্রে সেটা আলাদা বিষয়। এই বিষয়ে যদি কারো কোন প্রশ্ন থেকে থাকে বা পরামর্শ থেকে থাকে তাহলে আমাদেরকে ইমেইল ( tanbir@legalfist.com ) করে জানাবেন, আমরা পরবর্তী কোন আর্টিকেলে সেই বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আজকে এতোটুকুই, ধন্যবাদ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্ল্যাংক চেক নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন না তো?

অনলাইনে কেউ ভয়, বিরক্ত বা আক্রমণ করলে করণীয়

হানি ট্র্যাপ-মানি ট্র্যাপ: ভিকটিমের করনীয় কি?