সমকামিতা

সমকামিতা এবং আমাদের আইন

ফৌজদারি আইন

অস্বাভাবিক অপরাধ বা অপ্রাকৃতিক লালসা বা সমকামিতা হল, বিশেষ করে যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে একটি অস্বাভাবিক ইচ্ছা বা লালসা। অপ্রাকৃতিক লালসা এমন একটি শব্দ যা সাধারণত মূলধারার অভিধানে ব্যবহৃত হয় না এবং এটির জন্য কোন আদর্শ সংজ্ঞাও নেই। তবে, অস্বাভাবিক অপরাধ বা লালসার ধারণাটি একটি নৈতিক বা নৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা যেতে পারে, কেননা অস্বাভাবিক অপরাধ বা অপ্রাকৃতিক লালসা বা সমকামিতা চরিতার্থ করার জন্য স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ইচ্ছা বা আচরণগুলি অনুপযুক্ত থাকে বা যা কিনা অস্বাস্থ্যকর। তবে, একজন ব্যক্তি যা অপ্রাকৃতিক বা অস্বাভাবিক বলে মনে করেন তা অন্যের জন্য একই নাও হতে পারে। অন্যদের ব্যক্তিত্ব এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করা গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এবং সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতিতে পরিবর্তিত হতে পারে। এজন্য ১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা আমাদের দণ্ডবিধি প্রণয়নের সময় যাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে, এখন সেই ব্রিটিশ তথা গোটা পশ্চিমারাই গলা ফাটাচ্ছে, অস্বাভাবিক অপরাধ বা অপ্রাকৃতিক লালসা বা সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য।

 

সদ্য শেষ হওয়া কাতার ফুটবল ২০২২ এ ইউরোপীয়রা সমকামিতাকে প্রচার বা প্রসারের জন্য যে চেষ্টা বা অপচেষ্টা চালিয়েছিল, তা কাতার হয়ত কোন মতে ঠেকিয়ে দিয়েছিল, তবে এর জন্য সমালোচনা কিন্তু কম হয়নি পুরো ইউরোপ জুড়ে। তাই, সমাজ, সংস্কৃতি, দেশ ভেদে একেক জায়গায় একেক রকম চাহিদা যেমন আছে, তেমনি মানুষ ভেদে মানুষের মধ্যেও যৌন চাহিদা মিটানোর নানা পন্থা বিরাজমান। অনেকে একে মানসিক বিকারগ্রস্ত বা মানসিক সমস্যা বলে অভিহিত করছে। কিন্তু, অনেকেই আবার বলছে এটি পুরোপুরি বায়োলজিক্যাল। এমনকি বিজ্ঞানও এই বিষয়ে পরস্পর বিরোধী মতবাদ দিয়েছে, যার ফলে সার্বজনীন আইন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই, সর্বোপরি আমরা গোটা বিশ্ব নিয়ে আলোচনা না করে শুধু মাত্র আমরা আমাদের দেশের এবং আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করবো আজকের এই পর্বে।

আমাদের দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৩৭৭ এর অধীনে ‘অস্বাভাবিক অপরাধ/লালসা’র অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং এটিকে শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ৩৭৭ ধারার বর্ণনা করা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে কোনো পুরুষ, নারী বা পশুর সঙ্গে শারীরিক মিলন করে, সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা দশ বছর পর্যন্ত মেয়াদের জন্য যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডিত হবে। ব্যাখ্যা. এই ধারায় বর্ণিত অপরাধের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক মিলন গঠনের জন্য অনুপ্রবেশই যথেষ্ট।

এখানে খেয়াল করে দেখুন, ৩৭৭ ধারার ব্যাখ্যায় কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, অস্বাভাবিক অপরাধ বা অপ্রাকৃতিক লালসা বা সমকামিতা সম্পন্ন হওয়ার জন্য পরিপূর্ণ শারীরিক মিলন সংগঠনের প্রয়োজন নেই, কেবল শারীরিক মিলন গঠনের উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশই যথেষ্ট। যেহেতু অস্বাভাবিক অপরাধ বা অপ্রাকৃতিক লালসা স্বাভাবিক পন্থায় সহবাস বা যৌন সঙ্গম নয়, তাই পরিপূর্ণ অনুপ্রবেশ হয়ত অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নয়, তাই কোন আসামী যদি দাবী করে যে, সে তো পরিপূর্ণ যৌনাঙ্গ প্রবেশ করায়নি, তখন কিন্তু সে রেহাই পাবে না; অনুপ্রবেশই যথেষ্ট হবে।

৩৭৭ ধারা অনুযায়ী, “প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে” যে যৌন কার্যকলাপকে বুঝানো হয়েছে, তা কিন্তু একটি নির্দিষ্ট পন্থায় নয়। একজন নারী এবং একজন পুরুষ স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক যে পন্থায় বা উপায়ে যৌন সঙ্গম বা সহবাস করে থাকে, সেই উপায়ে যদি যৌন সঙ্গম বা সহবাস না করে অন্য যে ভাবেই যৌন সঙ্গম বা সহবাস করবে, তা অস্বাভাবিক বা অপ্রাকৃতিক অপরাধ বা লালসা হবে। তাছাড়া, নারীর সাথে নারীর, পুরুষের সাথে পুরুষের, কিংবা মানুষের সাথে পশুর যে পন্থাতেই যৌন সঙ্গম বা সহবাস বা যৌন সুখ অনুভব করবে তা হবে অস্বাভাবিক অপরাধ বা অপ্রাকৃতিক লালসা। যেহেতু অস্বাভাবিক অপরাধ বা অপ্রাকৃতিক লালসা বিভিন্ন পন্থায় বা উপায়ে ঘটে থাকে, তাই যে যে পন্থায় বা উপায়ে অস্বাভাবিক অপরাধ বা অপ্রাকৃতিক লালসা সংগঠিত হতে পারে এবং যেগুলো দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অধীন অপরাধী বলে গণ্য হতে পারে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুলো নিম্নরূপ:

  • Homosexuality/সমকামিতা হল একটি যৌন প্রবৃত্তি যেখানে একজন ব্যক্তি একই লিঙ্গের অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এটি একটি মানসিক ব্যাধি হিসাবে বিবেচিত হয় না এবং অনেক দেশে আইন দ্বারা সুরক্ষিত।
  • Bestiality/পাশবিকতা হল একটি যৌন ক্রিয়া যা একটি মানুষ এবং একটি প্রাণী জড়িত। এটি অপব্যবহারের একটি রূপ হিসাবে বিবেচিত এবং অনেক জায়গায় অবৈধ।
  • Buggery/বাগারি এমন একটি শব্দ যা কখনও কখনও পায়ূ সঙ্গম বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে দুই পুরুষের মধ্যে। এটি সডোমি নামেও পরিচিত।
  • Lesbianism/লেসবিয়ানিজম হল একটি যৌন প্রবণতা যেখানে একজন ব্যক্তি একই লিঙ্গের অন্যদের, বিশেষ করে মহিলাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। এটি একটি মানসিক ব্যাধি হিসাবে বিবেচিত হয় না এবং অনেক দেশে আইন দ্বারা সুরক্ষিত।
  • Sodomy/সডোমি এমন একটি শব্দ যা কখনও কখনও যৌন ক্রিয়াকলাপ বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যা অপ্রচলিত বা নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়, যেমন পায়ূ বা ওরাল সেক্স। এটি একই বা ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের মধ্যে যৌন কার্যকলাপ উল্লেখ করতে পারে। যদিও অনেক জায়গায় সোডোমি আইন ভেঙে দেওয়া হয়েছে, কিছু এলাকায় এখনও এটি অবৈধ।

 

এছাড়াও আরও বিভিন্ন উপায়ে এই ৩৭৭ ধারার অধীন অস্বাভাবিক অপরাধ বা অপ্রাকৃতিক লালসার অপরাধ সংগঠিত হতে পারে। ৩৭৭ ধারায় বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, সম্মতি নিয়ে প্রাপ্তবয়স্করা যৌন সঙ্গম বা সহবাস বা যৌন সুখ উপভোগ করলে তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হয় না। কিন্তু ৩৭৭ ধারার অধীনে সম্মতিমূলক সমকামী কার্যকলাপে জড়িত থাকার জন্য ব্যক্তিদের অভিযুক্ত এবং দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.