সাবেক স্বামী বা স্ত্রীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার

সাবেক স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামীর অধিকার

আমাদের সমাজে তালাক বা বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স হওয়ার পরে আমরা স্বামী বা স্ত্রীর আগে সাবেক বা এক্স শব্দটা ব্যবহার করে থাকি। এখনকার যুগে প্রেমিক-প্রেমিকরাও বিচ্ছেদ হওয়ার পরে সাবেক/এক্স শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। আবার কেউ কেউ প্রাক্তন শব্দটিও ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এখন এই সাবেক বা প্রাক্তন যে শব্দটিই আমরা ব্যবহার করে থাকি না কেন, আজকে আমরা জানার চেষ্টা করব সাবেক বা প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার রয়েছে কিনা সে সম্বন্ধে।

সাবেক বা প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার রয়েছে কিনা এই সম্বন্ধে জানার আগে, প্রথমেই জানতে হবে যে সাবেক হওয়ার যে প্রক্রিয়াটি সেটি কিভাবে হয়েছে। অর্থাৎ আপনার স্বামী বা স্ত্রী কিভাবে আপনার কাছ থেকে সাবেক হল?
প্রচলিত ধারা অনুযায়ী একজন স্বামী বা স্ত্রী সাবেক হতে পারে দুটি কারণে।

এক হচ্ছে, ডিভোর্স বা তালাক বা বিচ্ছেদের মাধ্যমে। আরেক হচ্ছে, মৃত্যুর মাধ্যম। তবে মৃত্যুর যে বিষয়টি সেক্ষেত্রে কেউই সাধারণত সাবেক বা প্রাক্তন শব্দটি ব্যবহার করেন না; যদি না মৃত্যুর পরে পুনরায় বিবাহ করে থাকে। সাধারণত একজন ব্যক্তি যখন তার স্বামী বা স্ত্রী মারা যাওয়ার পর পুনরায় বিবাহ করে, তখন সাধারণত তিনি তার মৃত স্বামী বা স্ত্রীকে নিজের পূর্বেকার জীবনসঙ্গী বা সাবেক বলে থাকে। তবে মৃত্যুর ক্ষেত্রে সাবেক বা প্রাক্তন শব্দটি শ্রুতি মধুর নয় বা শুনতে ভালো শুনায় না।
তবে সাবেক বা প্রাক্তন শব্দটি সবচেয়ে সুন্দর বা ব্যবহারে সার্থকতা হচ্ছে যখন ডিভোর্স বা তালাক বা বিচ্ছেদের মাধ্যমে কোন একটি বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। সেক্ষেত্রে তালাক দেওয়া স্বামী-স্ত্রীকে আমরা সাবেক স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে আখ্যা দিতে পারি।

এখন সাবেক স্বামী বা স্ত্রীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার সূত্রে অধিকার রয়েছে কিনা সেই সম্বন্ধে আশা করি সবাই অবগত। তারপরও বলার জন্য বলা যে, আমাদের মুসলিম আইন অনুসারে উত্তরাধিকার সূত্র সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, ব্যক্তি যখন মারা যাবে সম্পত্তি রেখে তখন ওই রেখে যাওয়া সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। এখন এই উত্তরাধিকারদের মধ্যে অন্য কারো সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয় না, শুধুমাত্র স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত। কারণ বাবা, মা, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে কারো সাথেই সম্পন্ন ছিন্ন বা বিচ্ছেদ হয় না; শুধুমাত্র স্বামী বা স্ত্রীর সাথেই তালাকের মাধ্যমে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে থাকে।

এখন মৃত্যুকালে যদি স্বামী বা স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় অর্থাৎ যে মুহূর্তে ব্যক্তি মারা যাচ্ছে সেই মুহূর্তে যদি উনার বৈবাহিক সম্পর্কটি ছিন্ন হয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রে উনার মৃত্যুতে উনার সাবেক স্বামী বা স্ত্রী উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পত্তি পাবেন না। উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেতে হলে অবশ্যই স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যু কালে বৈবাহিক সম্পর্ক বলবৎ থাকতে হবে। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম, তালাক বা বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের মাধ্যমে যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে সেই স্বামী বা স্ত্রী আপনার সাবেক হলেও তার কাছ থেকে আপনি উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পত্তি পাবেন না। তবে হ্যাঁ, স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে যদি আপনি আপনার দেনমোহর প্রাপ্য থাকেন যেটি বকেয়া রয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে সেটি আপনার স্বামীর সম্পত্তি বণ্টনের পূর্বেই আপনার বকেয়া আপনাকে পরিশোধ করতে হবে।

এবার আসুন মৃত স্বামী বা স্ত্রীর সম্পর্কিত সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে। আমাদের দেশে যেহেতু কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার সাথে সাথেই তার সম্পত্তি বণ্টন করা হয় না সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কোন ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে তিনি যদি পুনরায় বিবাহ করে থাকেন সেক্ষেত্রে ওই মৃত স্বামী বা স্ত্রীর সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুকালে উনি যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুষ্ট লোক এই যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করে যে, আমরা এখন সম্পত্তি বণ্টন করব কিন্তু মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রীর বর্তমানে আরেকজনের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ। এই যুক্তি দেখিয়ে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়ে থাকে বা চেষ্টা করা হয়ে থাকে। তাছাড়া আমাদের সমাজে অনেকেই লজ্জায় তার মৃত স্বামী বা স্ত্রীর সম্পত্তি আনতে যায় না যদি সে নতুন কোন জায়গায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকে।

তবে সন্তান যদি থেকে থাকে সেই ক্ষেত্রে সন্তানের অধিকার আদায় করার চেষ্টা করলেও নিজের অধিকার আদায়ের বেলায় বেশিরভাগ স্বামী বা স্ত্রী লজ্জাবোধ করে থাকে। কিন্তু মুসলিম আইন অনুসারে সম্পত্তি বণ্টনের নিয়মটি হচ্ছে, মৃত্যুর সময় যারা তার সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ এবং জীবিত তারাই সম্পত্তি পাবে। এখন যেহেতু একজন ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী যখন মারা গিয়েছে এবং মৃত্যুকালে তার সাথে সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, সেক্ষেত্রে তিনি ওই সম্পত্তিতে স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে যতটুকু সম্পত্তি পাওয়ার কথা ততটুকু সম্পত্তি তিনি অবশ্যই পাবেন। এবার সেটি যদি পাঁচ বছর বা দশ বছর পরেও বণ্টন করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রেও তাকে তার প্রাপ্য সম্পত্তি দিতে হবে।
এমনকি যেই ব্যক্তি সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারী সেই ব্যক্তি যদি মারা গিয়েও থাকে, অর্থাৎ আপনার স্বামী বা স্ত্রী মারা যাওয়ার কারণে আপনি ওনার সম্পত্তিতে যে উত্তরাধিকার হয়েছেন সেই সম্পত্তি বণ্টন প্রক্রিয়ায় যদি বিলম্ব হয় আর এর মধ্যে আল্লাহ্‌ না করুক, আপনিও যদি মৃত্যুবরণ করেন, সেক্ষেত্রে আপনার উত্তরাধিকাররা আপনার প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে পারবে।

মনে রাখবেন, দুষ্ট লোকরা সব সময় অপেক্ষা করে যাতে আপনার মৃত্যু হয়ে যায়, তাতে আর আপনি ওই সম্পত্তিতে অধিকার আদায় করতে না পারেন। তাই, আপনার উচিত হচ্ছে জীবিত অবস্থাতেই আপনার মৃত স্বামী বা স্ত্রীর সম্পত্তি বণ্টনের জন্য চেষ্টা চালানো। আপনি জীবিত অবস্থায় যতটুকু সম্পত্তি আদায় করতে পারবেন, সেটা আপনার মৃত্যুর পরে আপনার উত্তরাধিকারদের জন্য আরো বেশি জটিলতা সৃষ্টি করবে। বিলম্ব না করে, নিজের অধিকার নিজে আদায় করে নিন। আর আপনি যদি দাবী ছেড়ে দেন বা ওনাদের মধ্যে কাউকে দান করে দিতে ইচ্ছুক থাকেন, সেটিও করতে পারেন। তবে নিজে আদায় করতে চাইলে অবশ্যই আদায় করতে পারবেন, এটি ইসলামিক আইন; আল্লাহ্‌ আপনাকে যে অধিকার দিয়েছে, সেটি আদায়ে লজ্জার কিছু নেই।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই