কারাগারে নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির উপায় 

ফৌজদারি আইন

আলিয়া, ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ, প্রতিদিনের মতো তার স্বামীর জন্য দুপুরের খাবার তৈরি করছিল। তাদের সংসার ছিল শান্ত, তবে মাঝে মধ্যে অন্য আটদশটা স্বামী-স্ত্রীর মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতো। সেই দিনটি ছিল একটু ভিন্ন; আলিয়ার স্বামী কামাল অফিস থেকে ফিরে এসে খুব রাগান্বিত ছিলেন। অফিসে কিছু সমস্যার কারণে তার মেজাজ খুবই খারাপ ছিল এবং আলিয়া সেটি বুঝতে পেরে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে এক পর্যায়ে এই কথায় ঐ কথায় ছোটখাটো তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। আলিয়া মনে করেছিল তর্কটি শুধু সামান্য বিষয় নিয়ে, কিন্তু হঠাৎ করেই পরিস্থিতি তীব্র হয়ে ওঠে। রাগের বশবর্তী হয়ে আলিয়ার স্বামী কামাল তার উপর চিৎকার করতে থাকেন এবং তার প্রতি অসম্মানজনক কথাবার্তা বলতে থাকে। আলিয়ার চরিত্র নিয়ে কিছু একটা বলতেই রাগের উত্তাপে আলিয়া একটি কাচের জগ হাতের কাছে পেয়ে সেটা কামালের দিকে ছুঁড়ে মারে। জগটি কামালের মাথায় লেগে তাকে গুরুতর আঘাত করে। কামাল অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, আর আলিয়া আগপিছ চিন্তা না করে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

 

কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে কামাল মারা যায়। এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল, কিন্তু আইন অনুযায়ী, এটি একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। পুলিশ আলিয়াকে গ্রেপ্তার করে এবং তাকে আদালতে উপস্থাপন করে। আদালতে আলিয়া তার কাজের জন্য ক্ষমা চায় এবং এটিকে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে, তবে আদালত এটিকে একটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাকে দশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।

কারাগারে যাওয়ার পর আলিয়া সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে। আরও অনেক কিছু ঘটে গেছে এর মধ্যে, কিন্তু লং স্টোরি শর্ত, আলিয়ার সামনে একটি নতুন সুযোগ এসে দাঁড়ায়—বাংলাদেশ সরকারের “কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত নারীদের বিশেষ সুবিধা আইন, ২০০৬”। এই আইন আলিয়ার মতো নারীদের জন্য পুনর্বাসনের একটি সেতু তৈরি করে, যা তাদের কারাভোগের পর সমাজে নতুনভাবে স্থাপিত হতে সহায়তা করে।

আইনের অধীনে আলিয়ার সুবিধা প্রাপ্তির পথ

  • ১. শর্ত সাপেক্ষে মুক্তিঃ এই আইনের অধীনে, আলিয়া যদি তার কারাদণ্ডের ৫০%, অর্থাৎ ৫ বছর সফলভাবে কাটিয়ে দেয় এবং কারাগারের নিয়মাবলী মেনে চলে, তবে সে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আলিয়া যদি কারাগারে ভালো আচরণ প্রদর্শন করে এবং সংশোধিত জীবনে ফিরে আসার প্রমাণ দেয়, তবে তাকে তার বাকী দণ্ড মওকুফ করে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে।
  • ২. বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণঃ আলিয়া কারাগারে থাকাকালীন সময় বাটিকের কাজ এবং দর্জি বিজ্ঞান শিখতে পারে। এই প্রশিক্ষণগুলো তাকে কারাগারের বাইরে নতুন জীবন শুরু করতে সহায়তা করবে। উদাহরণস্বরূপ, মুক্তির পর আলিয়া যদি একটি ছোট দর্জির দোকান শুরু করে, তবে সে তার নতুন জীবনে সফলভাবে পা রাখতে পারবে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে।
  • ৩. আফটার কেয়ার সার্ভিসঃ আইন অনুযায়ী, আলিয়ার মতো নারীদের কারাভোগের পর সমাজে পুনর্বাসিত করার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক বিশেষ সহায়তা প্রদান করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, আলিয়া যদি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একটি ট্রেড কোর্সে প্রশিক্ষণ নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে আফটার কেয়ার সার্ভিস পায়, তবে সে তার জীবনে একটি স্থিতিশীল এবং সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
  • ৪. সরকারের দ্বারা ঘোষিত বিশেষ সুবিধাঃ সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী, গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারি করে আলিয়া এবং তার মতো অন্যান্য নারীদের জন্য আরও বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে বিশেষ পরিস্থিতিতে আলিয়াকে আরও কিছু বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হবে, তবে তা গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হতে পারে এবং আলিয়া তা গ্রহণ করতে পারবে।

বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির যোগ্যতা:

ধারা ৪ অনুযায়ী, যদি কোনো কয়েদি এক বছরের বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় এবং সে তার দণ্ডের ৫০% সময় সঠিকভাবে ভোগ করে, তবে তিনি বিশেষ সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হবেন।

আলিয়ার প্রেক্ষাপটঃ আলিয়া ১০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত, অর্থাৎ তাকে ১২০ মাস কারাভোগ করতে হবে। কিন্তু, যদি তিনি ৬০ মাস সফলভাবে কারাগারে থাকেন এবং কারাগারের নিয়মাবলী মেনে চলেন, তাহলে তিনি শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। এটি তাকে নতুনভাবে সমাজে ফিরে আসার সুযোগ দেবে, এবং বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে কারাগারের পরে পুনর্বাসিত হতে সহায়তা করবে। উদাহরণস্বরূপ, আলিয়া যদি কারাগারে কোনো বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নেন, তবে তিনি মুক্তির পর সেই প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে স্বনির্ভর হতে পারবেন।

বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির অযোগ্যতা:

আইনের ধারা ৫ এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিছু অপরাধে দণ্ডিত নারীরা এই বিশেষ সুবিধার অধিকারী হবেন না। আলিয়াকে দিয়ে এই অযোগ্যতার বিষয়গুলো উদাহরণস্বরূপ ব্যাখ্যা করা হলো:

(ক) মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদীঃ যেসব কয়েদী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত, তারা এই আইনের অধীনে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী নন। উদাহরণস্বরূপ, যদি আলিয়ার অপরাধটি পরিকল্পিত হত্যা হতো এবং তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতেন, তবে তিনি কোনো বিশেষ সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারতেন না। 

(খ) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদীঃ যদি কোনো কয়েদী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, তবে তিনি বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবেন না। আলিয়া যদি দশ বছরের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতেন, তবে তিনি এই সুবিধাগুলোর সুযোগ নিতে পারতেন না।

(গ) রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে দণ্ডিত কয়েদীঃ রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীরাও এই আইনের অধীনে বিশেষ সুবিধা পাবেন না। উদাহরণস্বরূপ, যদি আলিয়া রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতেন এবং তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সাজা দেওয়া হতো, তবে তিনি এই সুবিধার আওতায় আসতেন না।

(ঘ) বিস্ফোরক দ্রব্য, অস্ত্র আইন ও মাদকদ্রব্য সংশ্লিষ্ট অপরাধে দণ্ডিত কয়েদীঃ যদি কোনো কয়েদী বিস্ফোরক দ্রব্য, অস্ত্র আইন বা মাদকদ্রব্য সংশ্লিষ্ট কোনো আইনের অধীনে দণ্ডিত হন, তবে তিনি এই বিশেষ সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হবেন না। উদাহরণস্বরূপ, যদি আলিয়া মাদকদ্রব্য পাচারের মতো কোনো অপরাধে দণ্ডিত হতেন, তবে তিনি এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন।

আলিয়ার ঘটনাটি কাল্পনিক। কিন্তু, আপনার আশেপাশে যেসব নারী কয়েদী আছে, তাদেরকে উপরিউক্ত সুযোগ সুবিধাগুলো পাইয়ে দিতে তাকে এই সুবিধাগুলো সম্বন্ধে আগে অবগত করুন। আর এজন্য এই আর্টিকেলটি তাদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.