চেকের মামলা

প্রতিনিধির মাধ্যমে চেকের মামলা করা যাবে কিনা?

ব্যবসায়িক আইন

ইউসুফ একজন প্রবাসী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে কাজ করে অর্থ উপার্জন করে থাকেন। তার কষ্টার্জিত অর্থের কিছু অংশ তিনি আজম নামের একজন ব্যবসায়ীর কাছে বিনিয়োগ করেছিলেন। ব্যবসায়িক চুক্তি অনুযায়ী, আজম তাকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তার প্রমাণস্বরূপ ইউসুফের নামে একটি চেক ইস্যু করেন। কিন্তু যখন চেকটি ইউসুফের বিশ্বস্ত ব্যক্তি ব্যাংকে জমা দিতে যায়, তখন চেকটি ডিসঅনার বা প্রত্যাখ্যাত হয়। 

ইউসুফ যেহেতু প্রবাসে অবস্থান করছেন এবং নিয়মিত দেশে থাকতে পারেন না, তাই তিনি তার বিশ্বস্ত বন্ধু হারুনকে চেকের মামলা পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিতে চান। ইউসুফের মনে একটি প্রশ্ন জাগে: আইন অনুযায়ী কি হারুন তার পক্ষ থেকে ১৩৮ ধারার মামলা দায়ের করতে পারবেন? 

বাংলাদেশে Negotiable Instruments Act, 1881 এর ১৩৮ ধারা হলো একটি বিশেষ ধারা, যা চেক ডিসঅনার বা চেক প্রত্যাখ্যান সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য প্রযোজ্য। সাধারণত, চেকের প্রাপক বা গ্রহীতা নিজেই এই মামলাটি দায়ের করে থাকেন। তবে বিভিন্ন কারণে চেক গ্রহীতা যদি নিজে মামলা করতে না পারেন, তাহলে তিনি একজন প্রতিনিধি বা অনুমোদিত ব্যক্তির মাধ্যমে মামলাটি দায়ের করতে পারেন।

প্রতিনিধির মাধ্যমে মামলা দায়েরের আইনি ভিত্তিঃ মাদ্রাজ হাইকোর্টের Y. Sreelatha @ Roja v. Mukanchand Bothra [2002 (2) Crimes 19 (Mad)] মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, “Negotiable Instruments Act এর ১৩৮ ধারার অধীনে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি ধারকের মাধ্যমে মামলা দায়ের করা যায়।” অর্থাৎ, চেক গ্রহীতা যদি কোনো কারণে উপস্থিত না থাকেন, তাহলে তিনি তার প্রতিনিধি বা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি ধারকের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। 

বাংলাদেশে প্রতিনিধির মাধ্যমে মামলার ক্ষেত্রে আদালতের দৃষ্টিভঙ্গিঃ বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ Noor Hossain v. State [7 BLC (2002) 241] মামলায় মাদ্রাজ হাইকোর্টের মতামতকে সমর্থন করে। এই মামলায় আদালত বলেন যে, যদি চেক গ্রহীতা নিজে মামলা করতে না পারেন, তাহলে তার প্রতিনিধি বা অনুমোদিত ব্যক্তির মাধ্যমে মামলাটি দায়ের করা সম্পূর্ণ বৈধ এবং সঠিক।

এছাড়াও, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ Hashibul Bashar v. Gulzar Rahman and another [56 DLR (AD) 17] মামলায় বলেন যে, প্রতিনিধির মাধ্যমে মামলা দায়ের করা বেআইনী হবে না। বরং এটি আইনের সঠিক প্রয়োগ হবে, যা Criminal Procedure Code এর ২০০ ধারায় উল্লেখিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়।

কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধির মাধ্যমে মামলাঃ একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কোম্পানির পক্ষ থেকে যদি কোনো চেক ডিসঅনার হয়, তাহলে কোম্পানির কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী, যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হলেও, মামলাটি দায়ের করতে পারেন। দিল্লী হাইকোর্টের Standard Chartered Bank v. Ravi Bhandari [2002 (4) Crimes 308 (Del.)] মামলায় আদালত বলেন, “কোম্পানির পক্ষে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী মামলা দায়ের করতে পারেন, যদিও তারা বোর্ড অব ডিরেক্টর দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত না হন।”

প্রতিনিধির মাধ্যমে মামলা দায়েরের সুবিধা ও সমস্যাঃ প্রতিনিধির মাধ্যমে মামলা দায়েরের একটি বড় সুবিধা হলো, চেক গ্রহীতা নিজে মামলার জন্য উপস্থিত থাকতে না পারলেও তিনি তার স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ইউসুফ যদি প্রবাসে থাকেন এবং মামলা পরিচালনার জন্য দেশে আসতে না পারেন, তাহলে তিনি তার বিশ্বস্ত বন্ধু হারুনকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন এবং তার মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। 

তবে কিছু সমস্যা বা চ্যালেঞ্জও থাকতে পারে। প্রথমত, প্রতিনিধি বা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি ধারকের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা উচিত হবে না যদি তার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা না থাকে। দ্বিতীয়ত, আদালত যদি মনে করে যে প্রতিনিধি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি বা মামলার প্রক্রিয়ায় কোনো গাফিলতি করেছে, তাহলে মামলাটি দুর্বল হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ইউসুফ এবং হারুনের উদাহরণে, এটা স্পষ্ট যে ইউসুফ তার চেক ডিসঅনার সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য হারুনকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। বাংলাদেশের আইন এবং আদালতের বিভিন্ন রায় অনুযায়ী, এটি সম্পূর্ণ বৈধ। ইউসুফের উচিত হবে তার পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বা আনুষ্ঠানিক অনুমোদনপত্রের মাধ্যমে হারুনকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করা, যাতে হারুন সফলভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। 

তবে, ইউসুফের অবশ্যই এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে হারুন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা, এবং মামলার সমস্ত প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা। যদি সমস্ত আইনগত প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়, তবে ইউসুফের পক্ষে মামলাটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। 

এই ক্ষেত্রে হারুন যেমন ইউসুফের প্রতিনিধি হিসেবে মামলা পরিচালনা করবেন, তেমনিভাবে যে কোনো চেক গ্রহীতা তার প্রতিনিধি বা অনুমোদিত ব্যক্তির মাধ্যমে ১৩৮ ধারার মামলা পরিচালনা করতে পারেন। আদালত কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন রায় অনুযায়ী, এ বিষয়ে কোনো আইনগত বাধা নেই। সুতরাং, যেকোনো পরিস্থিতিতে, চেক ডিসঅনার সংক্রান্ত মামলার জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ একটি বৈধ এবং কার্যকর উপায়। 

তাই, যারা প্রবাসী বা দেশে এমন কোন কাজে ব্যস্ত বা নারী বা বয়স্ক বা অন্য যেকোনো কারনে নিয়মিত আদালতে গিয়ে মামলা পরিচালনা করতে সক্ষম নন, তখন তিনি চাইলে প্রতিনিধির মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। যারা এতদিন ধরে মনে করতেন যে, আপনাকেই মামলা করতে হবে আপনার চেক ডিসঅনারের জন্য, তারা আশা করি এখন নিজের অপারগতার জন্য মামলা করা থেকে পিছিয়ে থাকবেন না এবং নিজের প্রাপ্য টাকা আদায়ে আইনের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হবেন না। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.