cheque dishonour

চেকের ডিসঅনার – কি, কেন, কিভাবে? 

ব্যবসায়িক আইন

চেক কাকে বলে? 

চেক হলো একটি লিখিত আদেশ বা অনুরোধ, যা একটি ব্যাংক বা ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়, এমন একজন পক্ষ দ্বারা যার হাতে অর্থ রয়েছে, যিনি চান যে উক্ত আদেশ বা অনুরোধ উপস্থাপনের সময় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করুক, হয় চেকে নামোল্লিখিত ব্যক্তিকে বা বাহককে, অথবা সেই ব্যক্তি বা তার আদেশ অনুযায়ী অন্য কাউকে।

কে চেক ইস্যু করতে পারে? 

চেক ইস্যু করতে হলে, আপনার অবশ্যই একটি বৈধ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। এই অ্যাকাউন্ট খোলার সময় ব্যাংক আপনাকে একটি চেকবই প্রদান করবে। আপনি নিজের জন্য বা অন্য কারও জন্য চেক ইস্যু করতে পারেন। চেকে আপনি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা উল্লেখ করবেন, যা আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রদান করা হবে।

চেকের সাথে জড়িতদের কি বলে? 

চেকদাতা: যিনি চেক লিখে প্রদান করেন, তিনি চেকদাতা হিসেবে পরিচিত।

চেক গ্রহীতা: যার নামে চেক লেখা হয় বা যিনি চেকটি পাবেন, তিনি চেক গ্রহীতা হিসেবে পরিচিত।

চেক ডিসঅনার বলতে কী বুঝায়? 

চেক ডিসঅনার বলতে মূলত বোঝানো হয়, যখন একটি চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়, কিন্তু সেই চেকটি নগদায়িত না হয়ে ব্যাংক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। সহজ কথায়, চেকটি ভাঙানো সম্ভব না হয়। 

চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে উপস্থাপনের সময়সীমা কতদিন?  

১৮৮১ সালের “Negotiable Instruments Act” এর ১৩৮ ধারা (১) উপধারা অনুযায়ী, চেক ইস্যুর তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে অথবা চেকের কার্যকারিতা চলাকালীন সময়ে যেটি আগে ঘটে, সেই সময়ের মধ্যে চেকটি ব্যাংকে উপস্থাপন করতে হবে। এই বিধান একটি বাধ্যতামূলক শর্ত হিসেবে গণ্য হয়। সুতরাং, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে চেক উপস্থাপন না করলে আইন অনুযায়ী সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।

Munshi Md. Rashed Kamal v. Abdus Salam, 10 BLC (AD) 186 মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মতামত প্রদান করেছেন যে, চেক গ্রহীতা তার ইচ্ছানুযায়ী যতবার খুশি ততবার চেকটি নগদায়নের জন্য ব্যাংকে দাখিল করতে পারেন, তবে এটি অবশ্যই ৬ মাসের মধ্যে হতে হবে।

Ahsan Habib Chowdhury v. Multidrive Ltd, 14 BLC (2009) 66 মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ উল্লেখ করেছেন যে, অভিযোগকারী চেক দাখিলের নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করতে ব্যর্থ হলে, এটি ১৩৮ ধারার অধীনে মামলা দায়েরের জন্য একটি আইনি বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

চেক ডিসঅনার হয় কেন? 

চেক প্রত্যাখ্যান বা ডিসঅনার হওয়া অনেক কারণে হতে পারে। বাংলাদেশের ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারা অনুসারে, চেক প্রত্যাখ্যানের কারণগুলোর মধ্যে প্রধানত তহবিলের অভাব ছাড়াও অন্যান্য অনেক কারণ থাকতে পারে। একটি চেক যদি কোনো ব্যাংক নগদায়নের জন্য জমা করা হয় এবং তা প্রত্যাখ্যান করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক Cheque Return Memorandum-এ সেই প্রত্যাখ্যানের কারণ উল্লেখ করে চেকের প্রাপক বা ধারককে তা ফেরত দেয়।

এখানে চেক প্রত্যাখ্যানের কিছু সাধারণ কারণ উল্লেখ করা হলো:

  • ১. অপর্যাপ্ত তহবিল (Insufficient Fund): আপনার অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে চেকটি ডিসঅনার হতে পারে।
  • ২. অংকে ও কথায় গরমিল (Amount in figure and word differs): চেকের অংকটি যদি সংখ্যায় এবং কথায় ভিন্নভাবে লেখা থাকে, তবে চেকটি প্রত্যাখ্যান হতে পারে।
  • ৩. চেকের তারিখ উত্তীর্ণ বা পর-তারিখযুক্ত (Cheque out of date/post-dated): চেকটি যদি নির্দিষ্ট সময়ের পর জমা করা হয় বা কোনো ভবিষ্যতের তারিখে লেখা থাকে, তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
  • ৪. প্রদানকারীর স্বাক্ষর মিলে না (Drawer’s signature differs): চেকের উপর প্রদত্ত স্বাক্ষর যদি ব্যাংকের রেকর্ডের সাথে না মেলে, তবে চেকটি ডিঅনার হতে পারে।
  • ৫. প্রদানকারী কর্তৃক পরিশোধ বন্ধ করা হয়েছে (Payment stopped by drawer): চেক প্রদানকারী যদি ব্যাংককে চেকের পেমেন্ট বন্ধ করতে বলে, তবে চেকটি প্রত্যাখ্যান হবে।
  • ৬. রেখাঙ্কিত চেক; কোন ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদেয় (Crossed cheque; To be presented through a Bank): রেখাঙ্কিত চেক শুধুমাত্র কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে জমা দেওয়া যেতে পারে, সরাসরি নগদায়ন করা যাবে না।
  • ৭. প্রাপকের পৃষ্ঠাঙ্কন আবশ্যক (Payee’s endorsement required): প্রাপকের স্বাক্ষর বা অনুমোদন প্রয়োজন হলে এবং তা না থাকলে চেকটি প্রত্যাখ্যান হতে পারে।

এই সব কারণ ছাড়াও আরও কিছু অন্যান্য কারণ থাকতে পারে, যেমন:

  • – অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকা (Account closed)
  • – চেকের বিভিন্ন স্থানে পরিবর্তন থাকলে (Alterations in date/figures/words)
  • – ব্যাংকের স্ট্যাম্পের অভাব বা ভুল (Clearing stamp required)

চেক ডিসঅনার মামলা কোথায় এবং কীভাবে দায়ের করবেন? 

চেক ডিসঅনার মামলা একটি জটিল আইনি প্রক্রিয়া, যা অনেকের কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। আসুন সহজ ভাষায় বুঝে নেই কোথায় এবং কীভাবে এই ধরনের মামলা দায়ের করতে হয়।

চেক ডিসঅনার মামলা দায়ের করতে হবে সেই আদালতে, যার এলাকাধীন ব্যাংকে চেকটি নগদায়নের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছিল। এই আদালত হতে পারে:

  • ১) মহানগরের বাহিরে হলে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত
  • ২) মহানগরের মধ্যে হলে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত

ধরুন, আপনি একজন আইনজীবী এবং আপনার কাছে একটি মামলা এসেছে। আপনার ক্লায়েন্ট নোয়াখালীতে একটি চেক পেয়েছিলেন। তিনি সেই চেকটি ঢাকা মহানগরীর একটি ব্যাংকে জমা দিয়েছিলেন নগদায়নের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, চেকটি ডিসঅনার (অর্থাৎ বাউন্স) হয়ে গেল। এই ক্ষেত্রে, আপনি আপনার ক্লায়েন্টকে পরামর্শ দেবেন যে, তাকে ঢাকার আদালতে নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় মামলা দায়ের করতে হবে। কারণ, চেকটি ঢাকায় উপস্থাপন করা হয়েছিল এবং সেখানেই ডিসঅনার হয়েছে।

উল্লেখ্য: 

  • ১) মামলা দায়ের করার সময় সীমা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চেক ডিসঅনার হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেক প্রদানকারীকে নোটিশ দিতে হবে।
  • ২) নোটিশ দেওয়ার পরও যদি চেক প্রদানকারী টাকা না দেন, তবে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।
  • ৩) সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন চেকের কপি, ব্যাংকের ডিসঅনার স্লিপ, নোটিশের কপি ইত্যাদি সংগ্রহ করে রাখুন।

এই প্রক্রিয়া মেনে চললে, আপনি সঠিকভাবে চেক ডিসঅনার মামলা দায়ের করতে পারবেন।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.