নানার বাড়ি থেকে মায়ের সম্পত্তি কিভাবে উদ্ধার করবেন

নানা বাড়ির সম্পত্তিতে মায়ের হক আদায় করবেন কিভাবে?

জমি-জমার আইন

আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে দেনমোহর পরিশোধে এবং বোনদেরকে বোনদের হক বুঝিয়ে দেওয়ার বেলায় বেশ অপারগতা প্রকাশ পেয়ে থাকে। অন্য সকল দিক থেকে যে পুরুষকে সুপুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে, তলিয়ে দেখা যায় যে সেই ব্যক্তির নিজেও হয় নিজের স্ত্রীর দেনমোহর আজও পুরো পরিশোধ করেননি, নয়ত বাবার মৃত্যুর নিজের বোনদেরকে প্রাপ্য সম্পত্তি বুঝিয়ে দেননি। আবার, অনেকেই আছেন যাদের বাবারা মারা গিয়েছেন, কিন্তু বাবারা জীবিত অবস্থায় দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে ফুফুদের হক বুঝিয়ে দেননি, সেই সব ফুফুদের হক তাদের ভাইয়ের ছেলেরাও বুঝিয়ে দিতে চায় না। তথাকথিত নারীবাদীরা নারীর স্বাধীনতা নিয়ে যত মাতামাতি করে, তাদের একজনও কখনো বলতে শুনা যায় না যে, নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নারীকে প্রথমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি ঠিক থাকলে সবকিছু ঠিক থাকে, ঠিক না থাকলেও ঠিক করা যায়। কিন্তু, অর্থনীতি ঠিক না থাকলে বাকী সব দিক ঠিক থাকলেও রাষ্ট্রকে মাথা তুলে দাঁড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়। তদ্রূপ একজনকে আপনি যত স্বাধীনতাই দেন না কেন, যদি ঐ নারীর আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত না করেন, তাহলে ঘুরে ফিরে যে লাউ সেই কদু।

এখন নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিতের দাবী তুললে, অনেকেই গলা উঁচিয়ে বলতে শুরু করবে নারীরা তো আজ চাকরী করছে, ব্যবসা করছে, কোথায় কোথাও কি তারা বেতন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নাকি মুনাফা থেকে। আরও বলবে, এখনো নারীর রাজনীতি চর্চার অধিকারও সুনিশ্চিত করা আছে, যার উদাহরণ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, স্পিকার ইত্যাদি। দেখবেন, এইসব পুরনো গৎবাঁধা কথাগুলোর বাহিরে আর কোন কথা খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ, আপনি তদন্ত করে দেখবেন যারা নারীর স্বাধীনতা নিয়ে গলা ফাটায় তাদের বাড়িতে গিয়ে খবর নিয়ে দেখবেন তাদের স্ত্রীদেরকে তাদের দেনমোহরের হক পরিশোধ করা হয়নি বা বোন/ফুফুদেরকে তাদের পৈত্রিক হক বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এখানেও কেউ কেউ আমাকে কাউন্টার প্রশ্ন করতে পারেন যে, ভাই বোনকে সম্পত্তি দিচ্ছে না বলেই কি নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে? পুরুষ তো নিজে নিজে সম্পত্তি অর্জন করছে, উপার্জন করছে, তাহলে নারী কেন পারছে না?

কিন্তু, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বাপের সম্পত্তি থেকে যদি ছেলে তার হক আদায় করতে পারে, তাহলে মেয়ে কেন তার হক আদায় করতে পারবে না? যেখানে পবিত্র আল কোরআনের সূরা নিসাতে স্পষ্ট ছেলেকে মেয়ের দ্বিগুণ সম্পত্তি দেওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে, সেখানে আমরা কোন সাহসে মেয়েদেরকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করি। পবিত্র কোরআনে নিকৃষ্ট প্রাণীর মাংস খাওয়াকে হারাম করা হয়েছে, সেটা আমরা ঠিকই মেনে চলি কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের এতো সুস্পষ্ট বিধান আমরা মানতে চাই না। তার উপর আমাদের দেশের জমি জমার বিষয়ে একটা কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, দখল থেকে উচ্ছেদ করা মহা মুশকিল। তার উপর বোন তার ভাইকে, ফুফু তার ভাইয়ের ছেলেদের তাদেরই পৈত্রিক বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবে এটা কল্পনা করতেই পারবে না আমাদের মা বোনরা। কল্পনা করতে না পারার পিছনেও আমরাই দায়ী। আমরা আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন করে তৈরি করেছি যে, তাদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এটা তাদেরকে না বুঝিয়ে উল্টো তারা বাপের বাড়ি এসে জোরজুলুম করছে, এমন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে দেই। সেই প্রেক্ষাপট যুগ যুগ ধরে এমন ভাবে লালিত পালিত হচ্ছে যে, আমাদের অনেক সহজ সরল মা বোনেরা মনে করতে করতে বিশ্বাস করাই শুরু করে দিয়েছেন যে, বাপের বাড়ি থেকে সম্পত্তি আনলে না জানি ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, বাপের বাড়িতে গেলে হয়ত আর আদর আপ্যায়ন করা হবে না, বাপের বাড়ির সম্পত্তি স্বামীর বাড়িতে আনলে হয়ত দরিদ্রতা চেপে বসবে, বাপের বাড়ি থেকে নিজের হক নিয়ে আনলে ভবিষ্যতে স্বামীর বাড়িতে কোন সমস্যা হলে হয়ত ভাই-ভাইয়ের ছেলেরা পাশে এসে দাঁড়াবে না ইত্যাদি ইত্যাদি নানা ধরনের চিন্তা-দুশ্চিন্তায় পড়ে বাবার বাড়ি থেকে সম্পদ আনতে আমাদের মা বোনেরা আপত্তি করে। কিন্তু, মা বোনের এই আপত্তি আদৌ কতটা মন থেকে আর কতটা ভয়ে সেটা আমরা যাচাই করার ফুরসতই পাই না। অথচ, আমাদের সমাজে নিয়মিত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, যাকাত দেয়, হজও করেছে এমন ব্যক্তিও বোন বা ফুফুকে (বাবার অবর্তমানে বাবার বোন অর্থাৎ ফুফু) তার হক বুঝিয়ে দেওয়ার বেলায় সঙ্কোচ বোধ করেন। কেমন জানি, নিজেদের সম্পত্তি থেকে বোনকে বা ফুফুকে সম্পত্তি দিচ্ছে এমন একটা ধারণা তাদের সুস্থ বিবেককে বিকৃত করে ফেলছে। অথচ, বোনদেরকে তাদের হক দিতে হবে এটা হচ্ছে, সরাসরি আল্লাহ্‌র হুকুম। ভাই তার সম্পদ থেকে বোনকে দিচ্ছে না, বরং বোনকে বোনের ন্যায্য সম্পত্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই মানসিকতা তৈরি হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।



তারপরও ধরুন কারো মানসিকতা ঠিক হল না, তারা তাদের বোনকে বা ফুফুদেরকে তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে না, তখন আপনাকে নিজ দায়িত্বে আপনার সম্পত্তি বুঝে নিতে হবে। আপনি না পারলে আমরা ছেলে মেয়ে আছে যারা তাদের মামা বা মামাতো ভাই বোনদের বিরুদ্ধে লড়াই করে হলেও সম্পত্তি আদায় করে আনতে হবে। তবে, এই লড়াই শরীরের বা লাঠির লড়াই নয়, এটি আইনি লড়াই। আসুন দেখুন কিভাবে আইনি লড়াই লড়তে হবে, নানার বাড়ি থেকে মায়ের সম্পত্তি আদায় করতে হলে।

প্রথমে আপনার নানা বা নানী যার নামে সম্পত্তি ছিল ওনার সকল সম্পত্তির কাগজপত্র বের করতে হবে। এখানেও মামা বা মামাতো ভাই বোনরা বাঁধা দিবে। তাই নানার বাড়ি যে তহসিল অফিসের অধীন সেই অফিসে গিয়ে নানা বা নানীর নাম দিয়ে খতিয়ান তল্লাশি শুরু করবেন। এই ক্ষেত্রে আপনাকে সম্ভাব্য দাগ নাম্বার দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। খতিয়ান এক বা একাধিক হতে পারে। খতিয়ান পাওয়ার পর আপনি নিশ্চিত হবেন যে আপনার নানা বা নানীর নামে সম্পত্তি কি পরিমাণ রয়েছে। তারপর আপনার মায়েরা ভাই বোন কয়জন সেই হিসেবে উত্তরাধিকার হিসেবে আপনার মায়ের কত অংশ পাওয়ার কথা, সেটা বের করতে পারবেন। এবার ঘরোয়া ভাবে চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ আত্মীয় স্বজন নিয়ে একবার বসবেন আপনার মায়ের অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনার কাছে যেহেতু কাগজপত্র সব আছে, সেহেতু সালিশ করতে সালিশদারদের আর অসুবিধা হবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম অঞ্চলে আমি দেখেছি, মানুষ সালিশদারদের নিয়ে সালিশ করতে তো বসে, কিন্তু কাগজপত্র কিছুই প্রস্তুত না করে মুখে মুখে হিসেব করে, যার ফলে সালিশের পর সালিশ হয় কিন্তু জমি বুঝে পাওয়া যায় না। উল্টো সালিশদারদেরকে চা নাস্তা খাওয়ানোর পাশাপাশি কিছু সম্মানীও দিতে হয়। তাই কাগজপত্র প্রস্তুত করাকে অবশ্যই নিজের হোম ওয়ার্ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিবেন। সালিশদাররা কাগজপত্র পেলে আপনার মামা বা মামাতো ভাই বোনদেরকে সরাসরি সালিশের রায়ের ভিত্তিতে আপনার মায়ের অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্য করতে পারবে। এখন, কিছু লোক আছে সবাইকেই লাল কার্ড দেখিয়ে চলে, সালিশদারকেও মানে না বা ধরে নেন আপনার মামা বা মামাতো ভাই নিজেই চেয়ারম্যান বা মেম্বার বা প্রসিদ্ধ সালিশদার, তখন আপনার মায়ের হক কে বুঝিয়ে দিবে?

সেই ক্ষেত্রে আপনাকে আপনার নানা বা নানীর জায়গা যে জেলায় অবস্থিত, সেই জেলা জজ আদালতে গিয়ে বাটোয়ারা মামলা করতে হবে। বাটোয়ারা মামলা করতে গেলেও কিন্তু সালিশ করতে যে কাগজপত্র গুলো লাগবে সেগুলো আপনাকে উপস্থাপন করতে হবে। আর, একটা লম্বা সময় ধরে আদালতে যাওয়া আসার মানসিকতা রাখতে হবে। তাহলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর আদালত বাটোয়ারা আইন অনুসারে আপনার মায়ের অংশটি বের করে দিবেন, তখন আইনি প্রক্রিয়ায় আপনারা সেই অংশটুকু বুঝে নিতে পারবেন। সত্যি কথা বলতে, এটা একটা লম্বা প্রসেস। তাই, আমি ব্যক্তিগতভাবে ঘরোয়া পরিবেশে সালিশের মাধ্যমে সমাধান করাকে অগ্রাধিকার দিবো। সালিশের মধ্যেও অনেক সুন্দর টেকনিক রয়েছে, যেগুলো অবলম্বন করলে আপনি আপনার অধিকার আদায়ে কয়েক ষ্টেজ এগিয়ে থাকতে পারবেন। আর, অবশ্যই নিজে জমি জমার বিষয় ভালো না বুঝলে, বুঝে এমন কাউকে আপনার পক্ষে কথা বলার জন্য সাথে রাখবেন, এতে আপনার জন্যই সুবিধা হবে; তখন অন্তত নয় ছয় দিয়ে কেউ আপনাকে আপনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আর একটা কথা বলে শেষ করতে চাই, হক ইহকালে না পেলেও পরকালে নিশ্চিত পাবেন, তাই মারামারি, হাঙ্গামা, তুলকালাম না করে যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে আইনি প্রক্রিয়ায় নিজের হক আদায় করাটাই শ্রেয়।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.